পা কত সুন্দর হতে পারে

খালি পায়ে বসে আছেন রমা চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে আলাউদ্দিন খোকন। ছবি: মোহাম্মদ শাহজাহান
খালি পায়ে বসে আছেন রমা চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে আলাউদ্দিন খোকন। ছবি: মোহাম্মদ শাহজাহান

একদিন রমা চৌধুরী আমাদের কারওয়ান বাজার অফিসে এসেছিলেন। তারিখটা মনে নেই। বেশ কয়েক বছর আগে।

আমরা বেশ কয়েকজন আগেই জানতাম তাঁর সম্পর্কে। তিনি এসেছেন আলাউদ্দিন খোকনের সঙ্গে।

রমা চৌধুরীর খালি পা। যাঁরা জানেন না কেন খালি পা তাঁরা কৌতূহলী হলেন। আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু তাঁকে ঘিরে বসেছি। তিনি বন্ধুদের বয়সে নেমে আনন্দ আড্ডায় মেতে উঠলেন।

আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম কী?’

‘রওশন’

আমার নাম শুনে সে কী হাসি তাঁর। ‘মেয়েদের নাম।’ কত রকমের বিষয় নিয়ে আলাপে মেতে উঠলেন তিনি।

১৯৭১ সাল। চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে নিজের বাড়িতে রমা চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতিতা হলেন। তাঁর দুই সন্তানের সামনে। শুধু তাই নয়, তাঁর ঘরদোর পুড়িয়ে দেওয়া হলো।

বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী দিনযাপন শুরু করলেন খোলা আকাশের নিচে। রোদ-বৃষ্টি-শীত অপুষ্টিতে তাঁর দুই ছেলে মারা গেল।

একাত্তরের শেষের দিকে মারা গেল সাগর (৬)। বাহাত্তর সালে মারা গেল টগর (৪)। রমা চৌধুরী হলেন নিঃস্ব। তাঁর চার ছেলেসন্তান। ১৯৯৮ সালে তাঁর ২১ বছরের ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। বেঁচে রইলেন এক ছেলে জহর।

দুই ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি খালি পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন। কেন? ‘কেন’র উত্তর এমন—আমার ছেলেদের আমি যে মাটিতে রেখেছি সেই মাটিতে কি আমি জুতা পায়ে দিয়ে হাঁটতে পারি!

 চুয়াত্তর সালে তাঁর পায়ে হয়ে গেল সেফটিক। বাধ্য হয়ে জুতা পরা শুরু করলেন।

আটানব্বই সাল। তাঁর পা ভালো হলো। তবে সে বছর তাঁর ছেলে দীপংকর (২১) মারা গেলেন এক সড়ক দুর্ঘটনায়। আবার খালি পায়ে পথ চলা।

বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী, নিঃস্ব রমা চৌধুরী। জীবনযাপন স্থবির হয়ে গেল তাঁর। কিন্তু তাঁকে যে বাঁচতে হবে। লিখলেন রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি বই। বইটি প্রকাশের জন্য ঘুরছিলেন। সেই সময়ই পরিচয় হলো চট্টগ্রাম বন্ধুসভার তখনকার সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন খোকনের সঙ্গে।

 খোকন মাঝে মাঝে ভাবতেন ‘ইস্‌, একাত্তরে আমি যদি তরুণ থাকতাম তাহলে মুক্তিযুদ্ধ করার সৌভাগ্য হতো’।

রমা চৌধুরীর সব কথা শুনে আলাউদ্দিন খোকন ভাবলেন, ‘কি ভাগ্য আমার। আমার চেখের সামনে একাত্তর।’ সেই থেকে আলাউদ্দিন খোকন রমা চৌধুরীর সঙ্গে। কাটিয়ে দিলেন ২৪ বছর।

রমা চৌধুরীর সব দুঃখ-কষ্টে খোকন থাকলেন তাঁর পাশে। অভাবে-অনটনে, অসুখে-বিসুখে হাসপাতালে খোকন আছেনই। অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে খাইয়ে দেওয়া, স্নান করানো, ওষুধ খাওয়ানো সব সময় খোকন ।

 চট্টগ্রাম বন্ধুসভার অন্য বন্ধুরাও তাঁর সেবায় এগিয়ে এলেন।

২০০৫ সাল। তাঁকে যেতে হলো হাসপাতালে। ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। সাত দিন কোমায় থাকতে হলো। তারপর টানা দেড় বছর অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলেন ।

 আলাউদ্দিন কোথায়? আবার কোথায়, টানা দেড় বছর জননীর সেবায় কাটালেন।

রমা চৌধুরী জীবনে কারও কাছে হাত পাতেননি। মুক্তিযুদ্ধের ওপর বই লিখেছেন। সেগুলো বিক্রি করেই তিনি চলতেন।

ছোটবেলায় খোকন তাঁর মাকে হারিয়ে ছিলেন। রমা চৌধুরীর মাঝে তিনি কি তাঁর মাকে খুঁজে পেয়েছিলেন? ৩ সেপ্টেম্বর রমা চৌধুরী চলে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম বন্ধুসভার আলাউদ্দিন খোকনের কথাই আমার বারবার মনে পড়ছে। এমন ছেলেও হয়!

শুরুতে বলেছিলাম রমা চৌধুরীর খালি পা নিয়ে। সে কথায় আবার ফিরে আসি। বাংলা ভাষায় একটি কথা আছে, ‘পদধূলি।’ কারও কারও পদধূলি আমরা কামনা করি। তাঁর পদধূলি বন্ধুসভা কক্ষে পড়েছিল কি! অনেক উচ্ছ্বাস আবেগ নিয়ে বন্ধুসভা সম্পর্কে তিনি কথা বলছিলেন। জানালেন, তাঁর বন্ধু নম্বর ৯৮৮। আর খোকনের ৮৭। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে আমি রমা চৌধুরীর খালি পায়ের দিকে তাকাচ্ছিলাম। মানুষের পা কি এত সুন্দর হতে পারে!

লেখক: সভাপতি, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ