যুক্তরাষ্ট্র থেকে সিঙ্গাইর

ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল
ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল

কেউ কেউ গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে ঢাকায় এসে বাড়ি করেন। ফ্ল্যাট কেনেন। আবার কেউ কেউ আছেন, রাজধানীর সহায়–সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমান স্থায়ীভাবে। বসতি গড়েন সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পাড়ে। আর আমাদের এই ব্রাদার, যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়ার পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে জমি কিনলেন মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে। জমির তিন দিকে ধানখেত আর এক দিকে কাঁচা–পাকা রাস্তা। এখানেই তিনি স্থায়ীভাবে বসতি গড়লেন। বাড়ির নাম আপনগাঁও।

বাড়ি করলেন, তবে একা থাকার জন্য নয়। শিশু–কিশোর–তরুণেরা তাঁর বাড়ির সদস্য। গমগমে অবস্থা। আপনগাঁওয়ের সদস্য কারা? ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজালের (৮২) ভাষায়, ‘যাঁরা মাদক গ্রহণ করেন, তাঁরা পাগল নয়। তাঁরা খারাপও নয়। তাঁরা অসুস্থ। তাঁদের ঘৃণা করা যাবে না। তাঁদের ভালোবাসা দিয়ে সুস্থ ক​রতে হবে।’

এই ভালোবাসা দিয়েই বাংলাদেশে​র হাজার হাজার মাদকাসক্ত তরুণকে মাদকমুক্ত করেছেন।

আপনগাঁও থেকে যাঁরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন, তাঁদের অনেককে আমি চিনি​। তাঁদের একজন খন্দকার আসাদুজ্জামান। তিনি ​ছিলেন মাদকের অন্ধকার জগতের একজন বাসিন্দা। তিনি আমাকে বললেন, ‘ব্রাদার আমার দ্বিতীয় জন্মদাতা। তাঁর সংস্পর্শ না পেলে আমি হারিয়ে যেতাম।’

১৯৬২ সালে ব্রাদার বাংলাদেশে আসেন। প্রথম জীবনে বিভিন্ন মিশনারি স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। নানাভাবে নানাজনের সাহায্যে এগিয়ে গেছেন। তখন তিনি ​​​ছিলেন গাজীপুরের নাগরীতে।

ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল প্রেমে পড়ে গেলেন বাংলাদেশের। স্থায়ীভাবে থেকে গেলেন বাংলাদেশে। কাটিয়ে দিলেন ৫৩ বছর। ১৯৮৮ সালে মাদকের ভয়াবহতা তাঁকে চিন্তায় ফেলে দিল। তিনি জোরেশোরে শুরু করলেন মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা। তাঁর ভাষায়, যাঁরা ‘রোগী’, তাঁদের নিয়েই কাটিয়ে দিলেন জীবন। প্রথম আলো মাদকবিরোধী আন্দোলনের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে আয়োজন করা হয় পরামর্শ সহায়তার। আয়োজনটি মাদকাসক্ত ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্য। দেখেছি এই অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রণ না পেলে​ও চলে আসতেন, দায়িত্ববোধ থেকে। যাঁদের পরামর্শ দরকার, তাঁদের পরামর্শ দিতেন।

গাজীপুর স্কাউট মাঠে প্রথম আলো বন্ধুসভার প্রতি দুই বছর পরপর যে মহাসমাবেশ হয়, সেখানেও তিনি চলে আসতেন। শুধু বললেই হতো, ‘ব্রাদার, আসতে হবে।’ ব্রাদার বলতেন, ‘ঠিক আছে। আমি আসিতে পারব।’ মাদকের বিরুদ্ধে শপথ করাতেন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় তরুণদের সঙ্গে কথা বলতেন। তাঁদের সঙ্গে মিশে যেতেন বন্ধুর মতো। আমাদের এই বন্ধু তরুণদের বন্ধু। ১৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

যুক্তরাষ্ট্রে নিজের জমি বিক্রি করে এসেছিলেন বাংলাদেশে। অসুস্থ তরুণদের সুস্থ করতে। আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি স্যালুট জানাই। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

লেখক: সভাপতি, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ।