নীল পাহাড়ে নীল ময়ূরী

কল্পনা করুন তো, আপনি হাঁটছেন, পেছন পেছন আসছে আরও একজন। পুচ্ছ দুলিয়ে গটগট করে হেঁটে আসছে বাহারি ঝুঁটিঅলা প্রগাঢ় নীল রঙের এক ময়ূর। কিংবা ঘাস আর গাছগাছালির ফাঁক গলে উঁকি মারছে মিষ্টি দেখতে এক প্রাণী, নাম ওয়ালাবি। কী ভীষণ লাজুক ওর চাহনি! আপনাকে দেখে সে চোখ পিটপিট করে তাকায় আর ভাবে—নতুন অতিথি বেড়াতে এসেছে, সঙ্গে করে বাদাম এনেছে তো আমার জন্য!
আমি সিডনি শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত তারঙ্গা জুর কথা বলছি। সেখানে হরেক রকম প্রাণীর মেলা বসেছে যেন। সিটি সেন্টার বা টাউন হল থেকে ট্রেনে করে ‘সারি কী’ স্টেশনে এসে নামলেন, তারপর ক্যাপ্টেন কুক ক্রুজ শিপ বা ফেরিতে করে মিনিট পনেরো গেলেই চোখে পড়বে পাহাড়ের গায়ে জন্তু-জানোয়ারের বিশাল এক অভয়ারণ্য—দ্য তারঙ্গা জু, সিডনি।
প্রবেশপথে কোয়ালার দেখা পাই। ও বাবা, কী ভীষণ মিষ্টি দেখতে! জানেন তো, এরা বড্ড ঘুমকাতুরে। সারা দিন খালি ঘুমায় আর ঘুমায়। তথ্যমতে, কোয়ালারা দিনের মধ্যে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা ঘুমায়। গরম লাগবে তাই ইউক্যাপিসটাসগাছের শাখায় ওদের জন্য ফ্যানের ব্যবস্থাও আছে। কী আরামের জীবন ভাবুন!
তারপর এল রেড ক্যাঙারুর বিশাল সাম্রাজ্য। এরা মারসুপিয়াল জাতের প্রাণী। অর্থাৎ ক্যাঙারুর পেছনের দুই ঠ্যাঙের মাঝ বরাবর আছে একখানা পকেট, যার ভেতরে ওরা বাচ্চা লুকিয়ে রাখে। খুব ভীতু আর লাজুক কিনা। সামনের পা দুটো বেজায় খাটো, তাই ওরা হাঁটতে পারে না, শুধু হিপ-হপ করে লাফায়। লেজখানা কিন্তু বেশ লম্বা আর ডাগর। ওরা লেজের ওপর ভর করে দাঁড়ায়। খুব শান্ত আর নিরীহ প্রাণী ক্যাঙারু। ট্রি ক্যাঙারু ভুলেও মাঠে নামে না। গাছে গাছে দোল খায় আর অ্যাকাসিয়া বা ইউক্যালিপটাসগাছের কাঁচা পাতা খায়।
তারঙ্গা জু মানেই বেশুমার জন্তু-জানোয়ারের আনাগোনা। পাহাড়ি বুনোপথে হাঁটছি, হঠাৎ মনে হলো বেজির মতো দেখতে কিছু একটা সামনে দিয়ে দৌড়ে গেল। গাইড বললেন, এর নাম মিরকাত বা সুরিক্যাট। বিড়াল প্রজাতির হলেও এরা মাছ খায় না, সুরিক্যাট মাংসাশী প্রাণী। ওরা বঙ্গদেশি খাটাশ প্রকৃতির হবে বলে আমার অনুমান। চোখ দুটো অসম্ভব ধূর্ত দেখতে, গায়ে প্রবল শক্তি। ওরা দলেবলে চলে, সুযোগ পেলেই কোয়ালাছানা ধরে ধরে খায়। এই ভয়েই কিনা কোয়ালাবাবুরা কখনো নিচে নামে না, গাছের শাখায় হেলান দিয়ে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমায়।
অস্ট্রেলিয়ায় এসে লেমুর দেখবেন না, তাই কি হয়! ওরে বাবা, কত বড় ভয়ংকর চোখ! সত্যি, দেহের তুলনায় লেমুরের চোখ দুটো বড়। পানিতালের শাঁসের মতো। যদিও এরা মাদাগাস্কারের বাসিন্দা, কিন্তু কী করে যেন দু–চারটে লেমুর তারঙ্গা জু-তে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। বিশ্বায়নের যুগ কিনা, কেউ আর কোথাও থিতু হতে চায় না, শুধু চরে বেড়ায়।
আরেক অদ্ভুত প্রাণীর নাম ওমবাট। মিটারখানেক লম্বা, নাদুসনুদুস দেখতে ওমবাট গাছে ও মাটিতে বেশ মানিয়ে যায়। চেহারার বর্ণনা দিতে গেলে বলতে হয়, এরা বিড়াল বা পুডল কুকুরের মতো দেখতে, আদতে তাসমানিয়া দ্বীপের বাসিন্দা। না না, এদের পেটের নিচে পকেট নেই। এরা ঘাড়ে করে বাচ্চা নিয়ে ঘোরে। আপাতনিরীহ, তবে রেগে গেলে খবর আছে। রীতিমতো তেড়ে আসে।
খানিক বাদে মাইকে শোনা গেল, সিলের নাচ দেখবে যদি চলে এসো। চিড়িয়াখানার ভেতরে সুইমিংপুল, সেখানে সিল মাছের নাচ দেখানো হবে। ছুটে গিয়ে সিট দখল করি। আরে, কী আশ্চর্য! নাচের গাইড নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে আর সিলেরা মনের আনন্দে তা কপি করে। মাঝেমধ্যে অবশ্য রসদ হিসেবে ওদের মাছ খেতে দিতে হয়। অস্ট্রেলিয়ার সি-ফিশ গ্রোপার বা হোয়াইটিং। দেখতে আমাদের বাটা মাছের মতো। ছুড়ে দেওয়া মাত্র কপাৎ করে গিয়ে খায় নৃত্যপটীয়সী সিলেরা।
সিল-নৃত্য দেখে ফেরার পথ খুঁজছি, হঠাৎ দেখি মূল ফটক আগলে একজন দাঁড়িয়ে আছেন। ইনি কে! এর নাম ডিংগো। ছোটবেলায় জিওগ্রাফি বইয়ে এর ছবি দেখেছি, এবার তার চেহারা দেখলুম। কুকুরের মতোই দেখতে, তবে ইনি মাংসাশী প্রাণী। দ্রুত ছুটতে পারেন। পর্যটকেরা অকারণে বিরক্ত করলে তাদের কামড়ে দিতে কসুর করেন না ডিংগো।
আরে, ওই তো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আরও একজন আসছে। এর নাম ওয়ালাবি। ক্যাঙারুর ছোট সংস্করণ বলা চলে। আমাদের দেখেই অমনি লেজে ভর করে সামনের ছোট দুটো হাত (নাকি পা) বুক বরাবর এনে প্রণামের ভঙ্গি করে দাঁড়াল। তাই দেখে হেসে কুটিকুটি অগ্নিশ, আমার ছেলে। আজব তো! বণ্য প্রাণী এমন ভদ্র হয়! আমি মনে মনে বলি, ওরা কোনো কোনো মানুষের চেয়েও ভদ্র। একদম খাঁটি!