শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফাদার উইলিয়াম ইভান্স

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন ফাদার উইলিয়াম ইভান্স। যিনি মানবসেবার ব্রত নিয়ে ধর্মযাজক হিসেবে ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ জাহাজ মালঞ্চে ভারতবর্ষে আসেন। ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকার নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে ইছামতী নদীর পাড়ে পাকিস্তানি সেনারা এই মহান মানবসেবীকে হত্যা করে।

গোল্লা গির্জার সামনে ফাদার উইলিয়াম ইভান্স। ছবি: জেমস্ রাজ রোজারিও
গোল্লা গির্জার সামনে ফাদার উইলিয়াম ইভান্স। ছবি: জেমস্ রাজ রোজারিও


যুদ্ধের সময় নবাবগঞ্জের বক্সনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষা করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন। এটাই ছিল ফাদারের অপরাধ। সেদিনও তিনি কর্মস্থল গোল্লা থেকে নৌকায় কয়েক মাইল ভাটিতে বক্সনগর যাচ্ছিলেন। পথে তিনি শহীদ হন।

ফাদারকে বহনকারী নৌকার মাঝি মোহন মোল্লা পরে গোল্লা ধর্মপল্লিতে সেদিনের নৃশংস ঘটনার বর্ণনা করেন, যা এখনো গির্জার রেকর্ড বইতে লেখা রয়েছে:
‘১৩ নভেম্বর শনিবার ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দে বেলা ১: ১৫টায় ফাদারকে নিয়ে গোল্লা গীর্জা থেকে বক্সনগর উপ-ধর্মপল্লির উদ্দেশ্যে নৌকাযোগে মোহন মাঝি যাত্রা করেন। পথিমধ্যে নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে পৌঁছালে পাক সৈন্যরা তাঁর নৌকা পাড়ে ভিড়ানোর নির্দেশ দেয়। ফাদারকে ডেকে ক্যাম্পের ভিতর কমান্ডারের কাছে নেয়া হয়। সেখানে ১৫ থেকে ২০ মিনিট জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর নদীর পাড়ে এনে সৈন্যরা রাইফেলের বাঁট দিয়ে পেটাতে শুরু করে। বেয়নেটের খোঁচায় তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করা হতে থাকে। ভীতসন্ত্রস্ত মোহন মাঝি তৎক্ষণাৎ দৌড়ে নদীতে ঝাঁপ দেন। মাঝিকে লক্ষ্য করে দুইটা গুলি করা হলেও ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। তিনি সাঁতার কেটে নদী পার হন। ততক্ষণে সৈন্যরা ফাদারকে হত্যা করে মরদেহ নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। মোহন মাঝি বিকেল ৪টায় গোল্লা গির্জায় পৌঁছে এই খবর জানান।’

পরদিন ভোরে ঘটনাস্থলের কয়েক মাইল ভাটির গ্রাম বাহরা নদীর ঘাটে ফাদারের মরদেহ পাওয়া যায়। গোল্লা গির্জার রেকর্ড বই থেকে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ও ময়নাল হোসেন ফাদারের মরদেহ উদ্ধার করে গোল্লা গির্জায় সংবাদ পৌঁছে দেয়। পরে গির্জা থেকে আরও ১০-১২ জন যুবককে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা ফাদারের মরদেহ গির্জায় নিয়ে আসেন।

আর্চবিশপ গাঙ্গুলী ফাদার ইভান্সের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। গির্জার রেকর্ড বইতে তা সংরক্ষিত আছে। তিনি লেখেন, ‘ফাদার ইভান্সের মুখে গভীর ক্ষত ছিল, বেয়নেটের আঘাতে তাঁর নীচের ঠোঁট কেটে যায় এবং মুখের ভিতর দু-একটি দাঁত ভাঙা, দুইটি গুলি, একটি বাম দিকের পাঁজর দিয়ে ঢুকে ডান হাতের কাঁধের পাশ দিয়ে ভিতরে ঢোকে। অপরটি ডান দিকের কোমরের পাশ দিয়ে ভিতরে ঢোকে এবং দুটো হাতেরই ভিতর দিকে কাটা, হাত ও পায়ে অসংখ্য আঁচড়ের দাগ।’ সেদিন রোববার বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে গোল্লা কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

বক্সনগর গির্জার পাশেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। ফাদার ওই ক্যাম্পে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতেন। তা ছাড়া তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। এই খবর রাজাকারের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনারা জানতে পেরেছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ফাদারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

ফাদার উইলিয়াম ইভান্স ১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি ম্যাসাচুসেটসের পিটসফিল্ডে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা চার্লস ও মা রোজ ইভান্স। তিনি ১৯৪১ সালে হলিক্রস মিশন সেমিনারিতে প্রবেশ করেন। ১৯৪৫ সালের ১০ জুন যাজক হিসেবে অভিষিক্ত হন। মানবসেবার ব্রত নিয়ে ফাদার উইলিয়াম ইভান্স ১৯৪৫ সালের ভারতবর্ষে আসেন। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে অবস্থিত সিলেটের শ্রীমঙ্গল, ময়মনসিংহের বালুচড়া, ঢাকার হলিক্রস ক্যাথিড্রাল, নবাবগঞ্জের তুইতাল, বান্দুরা অবশেষে ১৯৬৭ সাল থেকে গোল্লা গির্জায় পুরোহিতের কাজ করেন।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ও https://issuu.com/jeromedcosta/docs/the_story_of_father_william_evans__c.s.c._-__missi