গতি

ড্রয়িংরুমে সবাই বসেছে। বিনতির বাবা-মা। ছোট খালা-খালু। মেজ মামা। আর বিনতির ছোট বোনও আছে।
মেজ মামা ডাকলেন, ‘বিনতি মা, এ ঘরে আয়।’
বিনতি হেডফোন লাগিয়ে ঘরে ঢুকল। ছোট খালা ডাকলেন, ‘দয়া করে হেডফোনটা খুলে বস।’ সে এক কানের হেডফোন খুলে সোফায় বসল। বলল, ‘তোমরা যা করবে তা আমি জানি। আমি ইভানকেই বিয়ে করতে চাই।’
মেজ মামা বললেন, ‘তোমাদের কত দিনের সম্পর্ক?’
‘মামা, এটা কোনো ম্যাটার করে না।’
মা বললেন, ‘ঢাকায় কি ওদের বাড়ি আছে। জমিজমা?’
‘ঢাকায় বাড়ি নেই। তবে জমিজমা আছে কি না, জিজ্ঞেস করিনি।’ এ কথা ভাবতেই ইভানের ফোন এল। বিনতি বলল, ‘ইভান, তোমাদের কি কোনো জমিজমা আছে। আমি লাউডে দিচ্ছি। বাসার সবাই তোমার কথা শুনছে।’
ইভান বলল, ‘সবাইকে শ্রেণিমতো সালাম ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আসলে আমাদের ঢাকায় কোনো বাড়ি নেই। দেশের বাড়িতে কোনো জমিজমাও নেই। ছোট বোনের বিয়ের সময় যতটুকু জমি ছিল, বিক্রি করা হয়েছে। সে কারণে দেশের বাড়িতে আমাদের যাওয়াও হয় না।’

বিনতির বাবা জানতে চাইলেন, ‘তোমাদের সংসার চলে কীভাবে। শুনেছি তোমার বাবার ডায়ালিসিস হচ্ছে?’
বিনতি লাউড অব করে বলল, ‘বাবা, তুমি প্রসঙ্গের বাইরে চলে গেলে।’
‘আশ্চার্য, এটা প্রসঙ্গের বাইরে হলো?’
ছোট খালা বললেন, ‘তুই এর আগেও প্রেমে পড়েছিলি? সে এখন নেই। ইভানও যে থাকবে, তার কোনো গ্যারান্টি আছে?
বিনতি বলল, ‘গ্যারান্টি নেই। জীবন এ রকমই। ছোট খালুর আগেও তো আমাদের আরেক খালু ছিল। ছিল না? তাহলে তুমি আমাকে এ প্রশ্ন করছ কেন?’
ছোট খালা রাগ করে সোফা থেকে উঠলেন। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘এ্যাই এসো। বাসায় কাজ আছে।’
ছোট খালা-ছোট খালু বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন।

বিনতির ছোট বোন বিথুন বলল, ‘আপু, কাজটা ঠিক করলে না।’
বিনতি রেগে বলল, ‘তুই চুপ কর। তুই আর ইভানের সঙ্গে কখনো ফেসবুকে চ্যাট করবি না।’
‘কোথায় চ্যাট করলাম। সেদিনের পর থেকে তো আর করিনি। বরং ইভান ভাইয়াই আমাকে ফোন দেয়।’ বিথুন মন খারাপ করে প্রস্থান করল।
মেজ মামা বললেন, ‘আমাদের এখানে আমরা ইভানের সঙ্গেই তোর বিয়ে দিতে চাই। আমরা ওদের আসতে বলি। বিয়ের সব খরচ আমরাই দেব। যেহেতু ওদের সামর্থ্য নেই।’
বিনতি বলল, ‘মামা, তোমরা কিন্তু আমার বিয়ে দিচ্ছ না। আমিই ওকে বিয়ে করছি। তোমরা রাজি না হলে আমি যে ওকে বিয়ে করব না, তা কিন্তু নয়। আর ওই পক্ষকে ডাকার কোনো দরকার নেই। আমাদের সময় হলে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে নেব।’

বিনতির মা মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকলেন। বাবার মাথা খুবই গরম হয়ে গেল। তিনি ডাকলেন, ‘বুয়া, এককাপ চা দাও তো।’
বিনতি উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘বাবা, তোমার সঙ্গে কিন্তু আমার একটা চুক্তি হয়েছে। আমি বাসায় থাকতে কারও হাতের বানানো চা খাবে না।’
বাবা বললেন, ‘না, আমি তোর হাতের চা খাব না।’
বিনতি বলল, ‘তা হয় না, বাবা। তোমাকে খেতেই হবে।’
সে উঠে গেল রান্নাঘরের দিকে।
মেজ মামা বললেন, ‘আমাদের কারও হাত নেই। যুগের হাওয়া ওদের টেনে নিচ্ছে আরেক দিকে।’
বিনতি চা নিয়ে এল। মামা বললেন, ‘বিনতি মা, ওর ব্লাড টেস্টটা করিয়ে নে। রক্তে অনেক কিছু ধরা পড়ে।’
এ কথায় বিনতি হাসতে হাসতে চলে গেল তার ঘরে।

গভীর রাতে বিনতির মনে হলো মেজ মামার কথা। ব্লাড টেস্ট কেন? সে ফোন করল তার এক বন্ধুকে। মেডিকেল থেকে পাস করে ইন্টার্ন করছে। সেই বন্ধু অরূপ তাকে সব বুঝিয়ে দিল।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে ইভানকে ফোন দেয়। আজও দিল। বলল, ‘ইভান, আজ তোমার ব্লাড টেস্ট করতে হবে।’
‘কেন, কী হয়েছে আমার?’
‘কিছু হয়নি। তবু যদি কিছু পাওয়া যায়।’
‘বিনতি, পাগলামি কোরো না তো। আমি টেস্ট করব না।’ সে ফোন কেটে দিল। কিন্তু বিকেলবেলা ঠিকই সে রাজি হলো এবং ব্ল্যাড দিয়ে এল। শুধু ব্ল্যাড নয়, ইউরিনও।
ইভান মাদক গ্রহণ করে। পরীক্ষায় তাই প্রমাণিত হলো।

চমকে উঠল বিনতি। ‘তুমি আমাকে কখনো বলোনি। আশ্চার্য। এক বছর ধরে তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক।’
‘আমি তোমাকে কী বলব। কোনো ধরনের নেশা আমি করি না। করলে তোমাকে বলতাম। এ্যাই তোমার গা ছুঁয়ে বলছি।’
বিনতি বলল, ‘তুমি যখন আমার গা ছোঁও, তখন আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু এখন আমার কোনো ফিলিংসই হচ্ছে না।’
বিনতির কথায় হাতটা সরিয়ে নিল ইভান। সম্ভবত লজ্জায় তার মুখটা লাল হয়ে গেল।

মামার কথায় ডাক্তার সহিদ আব্বাসের কাছে গেল বিনতি। ডাক্তার বললেন, ‘রিপোর্ট তো পজিটিভ। তোমার বন্ধু অস্বীকার করলে তো আর রিপোর্ট নেগেটিভ হয়ে যাবে না।’
‘এটা কি সারানো যায় না।’ বিনতি কাতর স্বরে জানতে চায়। ‘অবশ্যই যায়।’ তবে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। সারার পরেও বারবার নেশায় আসক্ত হতে পারে। আচ্ছা, একটা কথা বলি। তোমার ঠোঁটটা এত কালো কেন? তুমি কি...?’
‘ডাক্তার সাহেব আপনি কিন্তু অন্যদিকে চলে যাচ্ছেন?’
ডাক্তার হেসে বলরেন, ‘চা, খাবে? আমি অনেক সময় পেসেন্টদের সঙ্গে চা খেতে খেতে কথা বলি।’

‘স্যরি, আমি কিন্তু পেসেন্ট নই।’
‘ওকে, যা বলছিলাম। তুমি কি সিগারেট খাও। তোমার মুখ দিয়ে সিগারেটের গন্ধ আসছে।’ ডাক্তার সাহেব জানতে চান।
‘এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’
ডাক্তার আবার হাসেন। বলেন, ‘ফালতু স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করো না। বলো খাও কি না?’
‘জি, খাই।’
‘আহারে, তাহলে তো তুমি গেটওয়েতে আছ।’
‘মানে?’
‘মানে হচ্ছে, যারা ধূমপান করে, তাদের অন্যান্য মাদক গ্রহণ করার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। তুমি আমার কাছে আবার পনেরো দিন পরে আসো। প্রথমে তোমার চিকিৎসা করি। সিগারেটের নেশা ছাড়াই, তারপর তোমার বন্ধুর।’
বিনতি বলল, ‘এটা তো আমি আজই ছেড়ে দিতে পারি।’
ডাক্তার সাহেব চেম্বার ফাটিয়ে হাসলেন। বাইরের একজন রোগী অ্যাডেনডেন্সকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এভাবে হাসতাছে যে?’
‘উনি এ রকমই...।’

ডাক্তার হাসি থামিয়ে বললেন, ‘তুমি বললে আজই ছেড়ে দিতে পারি। তাহলে ছেড়ে দাও। তোমার বাম বুকপকেট উঁচু হয়ে আছে। সিগারেটের প্যাকেট। প্যাকেটটা এখনই ফেলে দাও।’
বিনতি একটু লজ্জা পেল। জিনসের প্যান্ট আর ফতুয়া পরেছে। ওড়না নেই। ওড়না থাকলে যেন সে সেটা বুকের ওপর টেনে দিতে পারত।
ডাক্তারকে বলে এল প্যাকেটের সিগারেটগুলো শেষ হলে আর খাবে না। যদিও বিনতি এর আগেও কয়েকবার সিগারেট ছেড়েছে। আবার ধরেছে।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মা ডাকলেন বিনতিকে। তখনো সে ঘুমিয়ে আছে, বিছানা ছাড়েনি।

‘মা, প্লিজ, বিরক্ত কোরো না তো। আমি উঠে গোসল-টোসল করে একবারে লাঞ্চ করব। ১টার দিকে ডেকে দিয়ো। মা, তোমার নাশতাটা বেঁচে গেল। হিঃ হিঃ।’
আবার ডান কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে। মা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কী স্নিগ্ধ চেহারা তার মেয়ের। কী শান্ত ছিল ছোটবেলায়। সারাক্ষণ মায়ের পাশ ঘেঁষে থাকত। আর এখন? কত দূরে চলে গেছে সে। তাকে চেনাই যায় না। মা তাঁর ডান হাতটা মেয়ের মাথায় রাখলেন।
চোখ বন্ধ করেই বিনতি বলল, ‘মা, যাও তো। আরেকটু ঘুমাতে দাও।’
দুদিন পর মা জানতে চাইলেন, ‘বিনতি ইভানের খবর কিরে? তোদের বিয়ে কবে হচ্ছে?’
‘বিয়ে?’

মা বললেন, ‘হ্যাঁ বিয়ে। ইভানকে কবে বিয়ে করছিস?’
বিনতি বলল, ‘বিয়ে ক্যানসেল করে দিয়েছি, মা। এখন লিভ টুগেদার করব।’
‘মানে?’
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বিনতি বলল, ‘মা, না বোঝার ভান করো না তো।’
‘তার মানে বিয়ে না করে আমরা একসঙ্গে থাকব। ওর চাকরিটা হোক। আমারও দুই মাস পরে একটা চাকরি হয়ে যাচ্ছে।’
ইভানের চাকরি হলো ঠিকই, কিন্তু সেটা সে ধরে রাখতে পারল না। নেশা করে ধরা পড়ে গেল। বস তাকে ডেকে সময় বেঁধে দিলেন। ‘যদি তুমি এক মাসের মধ্যে নেশা ছাড়তে না পারো, তাহলে তোমার চাকরি চলে যাবে।’
ইভান বলেছিল, ‘স্যার, ছয় মাসের সময় দিন।’
‘তুমি কি নিশ্চিত ছয় মাসে তুমি নেশা ছাড়তে পারবে। আর কীভাবেই বা বুঝলে?’
‘স্যার, আমি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম...। আমি ভালো হতে চাই।’

‘না, এক মাস।’ বস কিছুতেই মানবে না। চাকরিটা চলেই গেল। ইভান এখন আরও বেশি আসক্ত। বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া লাগে।
বাবা-মা দুজনই অসুস্থ। তাঁদের সেবা করারও কেউ নেই।
বাবা একদিন ইভানকে ডেকে বললেন, ‘ইভান, তোকে আমি মাসে মাসে কিছু টাকা দেব। তুই বাসাতেই থাক। রান্নাবান্না করে আমাদের খাওয়াবি। আর আমাদের সেবা–যত্ন করবি।’
ইভান রাজি হয়ে গেল। অন্তত নেশার টাকাটা নিশ্চিত।
বাবা ব্যাংকের চেক বইয়ে স্বাক্ষর করে দেন আর ইভান ইচ্ছেমতো টাকা তোলে। এতে যা হলো, ইভানের নেশা আরও বেড়ে গেল। বাসায় পড়ে পড়ে ঘুমায়। বাবা-মায়ের সেবা তো দিল্লি দূর অস্ত। ইভানের নিজেরই সেবা দরকার হয়ে পড়ল।

বাবা-মা শুয়ে শুয়ে ছেলের নেশা করা দেখেন। মা অনেক কষ্টে রান্না করেন। ছেলেকে শিশুর মতো খাইয়ে দেন।
বন্ধুরা বলল, ‘তোর বাবা-মা তো এভাবে মারা যাবে। বাসা ছড়ে দে। ওনাদের ওল্ড হোমে দিয়ে আয়।’
বাবা বললেন, ‘ঠিক বলেছিস। এভাবে তো আমার ব্যাংকের সব টাকা শেষ হয়ে যাবে। ওল্ড হোমে আমরা সেবা–যত্নও পাবো।’
মা কেঁদে বললেন, ‘ও কোথায় থাকবে। ওকে কে রান্না করে দেবে?’
বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘ও যা খায় তা–ই যথেষ্ট। রান্না করা খাবার ওর দরকার নেই।’
ইভান বুঝতে পারল, ‘বাবা কী বলছেন।’

মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মা, আমি ভালো দেখে একটা মেসে উঠে পড়ব।’
ইভান তার বাবা-মাকে গাজীপুরে একটা ওল্ড হোমে রেখে এল। ঢাকায় ফিরে তার বেশ ঝরঝরে লাগছে। তাকে আর কেউ শাসন করবে না। চোখের সামনে বাবা–মায়ের কষ্টও দেখতে হবে না।
বিনতি একটা চাকরি পেয়েছে। ভালো বেতন। অফিস থেকে একটা স্কুটি দিয়েছে। সেটা চালিয়ে সে অফিসে যায়।
একদিন দুপুরে কলাবাগানের এক গলিতে ইভানকে খুঁজে পেল বিনতি। বলল, ‘আমি একটা দুই রুমের বাসা নিয়েছি। তুমি আর আমি থাকব। আর তোমাকে ডাক্তার সহিদ আব্বাসের কাছে যেতে হবে। চিকিৎসা নিতে হবে।’
ইভান বলল, ‘তাহলে তো আমাদের বিয়ে করতে হবে?’

বিনতি বলল, ‘ব্যাকডেটেট কথা বলো না তো। চলো এক্ষুনি স্কুটির পেছনে বসো। এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে তোমাকে নিয়ে যাব।’
বিনতি স্কুটি স্টার্ট দিল। পেছনে বসল ইভান। বিনতি বলল, ‘ভালোভাবে বসো।’
বিনতির স্কুটি গলি থেকে মিরপুর রোডে উঠতেই ইভান পেছন থেকে পড়ে গেল। কিন্তু স্কুটির গতি কমল না। বিনতি কি বুঝতে পারছে না তার পোছনে ইভান নেই!