সাপিনী ও সাপুড়ে

অলংকার- মাসুক হেলাল
অলংকার- মাসুক হেলাল

বড় সুন্দর মেয়েটা। মমতাজ। নামের মতোই সে। পশ্চিমপাড়ার পোস্টমাস্টার হালিম শেখের বড় ছেলে সেলিম শেখের বউ হয়ে এল। নতুন বউয়ের চোখে স্বপ্নাতুর এক বিভোর দৃষ্টি। সম্মোহিতের মতো। ডুবে যেতে ইচ্ছে করবে যে-কারোর। গ্রামসুদ্ধ লোক হিংসায় পুড়ছে—অমন সুন্দর একটা বউ পাইল কেমনে! সেলিম্মা সাত-কপাইল্লা, কালা পোলার ধলা বউ—ব্যাক-ই খোদার ক্যারামতি!

বিয়েশাদির তোড়জোড় চলছিল অনেক দিন ধরে, কিন্তু ভালো পাত্রীর সন্ধান মিলছিল না। সেলিম নৌবাহিনীর একজন সদস্য। ছুটিতে বাড়ি আসার সময় ভেবেছিল, এবারও বুঝি বিয়েটা তার হবে না! কিন্তু হয়ে গেল। সে নিজেও কখনো ভাবেনি তার ভাগ্যে এমন সুন্দর বউ জুটবে। তার গায়ের রং ময়লা, একটু বেশিই ময়লা। দেখতেও চটকদার নয়। সে লম্বা, শক্তপোক্ত গড়নের বটে, তবে কোনো সুন্দর মেয়ে যেচে তার দিকে হেলে পড়বে না—সে জানত, এত দিনেও কেউ পড়েনি। তাই হয়তো ওপরঅলা মমতাজকে পাইয়ে দিলেন। প্রথম যখন ঘটক এসে খবর দিল—মাইয়াডা দেখার লাহান সুন্দর, সেলিম বাবাজির পছন্দ না হইয়া পারব না! সেলিম তখন মুচকি হেসেছিল, আমাকে পছন্দ করবে কি না সে খবর আগে নিন, শেষে না সবাই বেইজ্জতি হন।
ঘটক হো হো করে ওঠে, ব্যাবাক মোর ওপরে ছাইড়া দ্যান। এই রকম পোলা দশ গ্রামে আর একটা আছেনি? তাও যে-সে পোলা না, সরকারি চাকরি করা পোলা!
কিন্তু সেলিম মনে করে আল্লাহ তার কপালে মমতাজকেই লিখে রেখেছিলেন। প্রথম দিন পাত্রী দেখতে গিয়ে ঘটকের কথার সত্যতা মিলল। ঘটকেরা তো মিথ্যে ছাড়া সত্য তেমন বলেই না, বানিয়ে বানিয়ে গল্প ফাঁদতেও ওস্তাদ। মমতাজের বেলায় ঘটক মিথ্যেও বলেনি, বাড়িয়েও বলেনি।
মমতাজ মাথা নিচু করে রেখেছে, মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে দেওয়া। এক পলকে সেলিমের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আচমকা তার বুকের ভেতর ওলট–পালট লাগল, কেমন শূন্য শূন্য, গলা শুকিয়ে এল—পিপাসা পেল। তার মনে হলো, এই পরিটা মাটিতে কী করে, ওর তো মেঘের দেশে ঘুরে বেড়ানোর কথা! সিনেমায়ও সে এত সুন্দর কাউকে দেখেনি। তার ভয় হলো, এই মেয়ে এখনই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে এবং বলবে, এই কালো ভূতটাকে আমি বিয়ে করতে পারব না!
অপমানের কথা, তবু সেলিমের খুব হাসি পেল, কিন্তু সে হাসি চাপা দেয়।

শেষমেশ তার কোনো আশঙ্কাই সত্য হয়নি। বিয়ের পাকা কথা হয়ে যায়। ভালো একটা দিনক্ষণ দেখে বিয়ে হবে। পাত্রপক্ষ তাড়া দিল—শুভ কাজে দেরি করার মানে হয় না।

শুক্রবার। বিয়েটা ধুমধামের সঙ্গে হলো। দুই গ্রামের লোক এল নতুন বউ দেখতে। সেলিমের মনে হলো, সবাইকে তো আর দাওয়াত দেওয়া হয়নি, এত লোক খবর পেল কীভাবে? তা ছাড়া সবাই এত সময় নিয়ে বউ দেখবে কেন? অদ্ভুত সব মানুষ! ছোট ছোট ছেলেমেয়েও নতুন বউয়ের সঙ্গে সেঁটে রইল। এদিকে বরের রাগ ধরে। বন্ধুরাও টিপ্পনী কাটে—সেলিম্মা বউ একখান পাইছে, সেই রকমের সুন্দরী! সেলিমের চোখেমুখে রাগ প্রকাশ পেলেও মুখে কিছু বলতে পারল না। এক দঙ্গল মানুষের ভিড়ে এখন কেউ যদি খেয়াল করে তাকে দেখত, তবে বরের করুণ আর হিংসাত্মক মুখটাই দেখতে পেত। বরকে দোষ দেওয়া চলে না, আহা বেচারা। কখন নতুন বউকে কাছে পাবে!

ভিড় পাতলা হলো। ফুরসত এল। দ্বিধাগ্রস্ত নতুন বর। মুখে ভাষা পায় না। তার ইচ্ছে করে নতুন বউয়ের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে—রাত ভোর হোক। এত সুন্দর হয় কোনো মানুষ? মনের কথা মুখ থেকে টুপ করে বেরিয়ে এল—তুমি এত সুন্দর কেন?
রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল নতুন বউয়ের মিষ্টি হাসিতে। রিনরিনে সে হাসি বুকের ভেতর নাচন তোলে। সেলিমের বিহ্বল অবস্থা। কিছু ভেবে পায় না। ইচ্ছে করে মমতাজ নামের অতি সুন্দর এই মেয়েটার সঙ্গে অনেক অনেক কথা বলতে, তার বুকের ভেতর অনেক কথা জমে আছে। সব, সব কথা সে বলতে চায়...

নতুন বউয়ের গায়ে কী যে অদ্ভুত গন্ধ! ঘোর লাগে তার।
রাত দ্রুত ফুরিয়ে আসে। বাইরে ফিকে আলোয় মমতাজকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে ইচ্ছে করছে! সে ভুলে যেতে চায়—মানুষ, পরিবেশ, সময়ের কথা। মমতাজ সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে স্বামীর মুখের দিকে। বাধ্য হয়ে অবিন্যস্ত শাড়ির পাড়, আঁচল ঠিক করে বাইরে পা রাখে।
পুকুর ঘাটে এল দুজন। পুকুরের জলে ভোর আকাশের কালো ছায়া দেখে সেলিমের মনটা ভরে ওঠে। চারপাশে যা দেখে তা–ই ভালো লাগছে। বউকে বলে, মম, তুমি এখানে এক মিনিট দাঁড়াও, আমি আসছি—
ছুটে গেল সে। ফিরেও এল দ্রুত। হাতের মুঠোয় কাঠপোড়া কয়লা! মাটির চুলা হাতড়ে নিয়ে এসেছে। দম নিয়ে বলল, নাও, দাঁত মাজো, আমি তোমার দাঁত মাজা দেখি...
মমতাজের চোখ কপাল ছোঁয়! কৌতুকের হাসি মুখে নিয়ে বলে, আপনি কী সব পাগলামি করছেন, বলেন তো?
—পাগলামি না, এটা আমার স্বপ্ন, নতুন বউ পুকুর পাড়ে বসে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজছে আর আমি সে দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখছি...
—এ যুগেও কেউ কয়লা দিয়ে দাঁত মাজে!
—মাজে মাজে, আমার পরি বউটা আজ মাজবে...
মমতাজ হার মানে। সেলিম মুগ্ধ হয়ে মমতাজের দাঁত মাজা দেখে...! সে বলে, তুমি সাঁতার জানো?
—গ্রামের মেয়ে যখন সাঁতার তো জানিই।
—চলো, আমরা পুকুরে সাঁতার কাটি...একটা জলকন্যার সঙ্গে সাঁতার কাটার ভাগ্য সবার হয় না, আমার হয়েছে...
—আপনার ইচ্ছে হয় সাঁতার কাটেন।—মমতাজের কণ্ঠে বিরক্তি প্রকাশ পায়।
সেলিম তা আমলে নিল না।
সে মমতাজের হাত ধরে পুকুরে নামল...

২.
সেলিমের ছুটি শেষ। ঘরে নতুন বউ রেখে যেতে কার মন টানে? সরকারি চাকরি, যেতে হয়। মাস পুরতে না–পুরতে সে আবার বাড়ি এল। একটা মাস তার কেমন করে কেটেছে, তা কেউ বুঝবে না!
বৃদ্ধ মা-বাবা সরাসরি কথাটা বলেন ছেলেকে—বাবা সেলিম, আমাগো বয়েস হইছে, তাড়াতাড়ি নাতি-নাতনি মুখ দেইখা মরতে চাই—আমাগো তো আর চাওনের কিছু নাই; বউমারেও জানাইছি...’

সেলিম রাতে মমতাজকে বাবা-মায়ের কথাটা তুলল। মমতাজ কিছু বলল না, চুপ করে শুনল।

বছর ঘুরল। সুসংবাদ শোনার কোনো চিহ্ন দেখা গেল না। তবে সেলিম এখনো দুশ্চিন্তার কিছু দেখল না। শুধু বৃদ্ধ হালিম শেখের কপালে চিন্তার ভাঁজ।

বিয়ের দ্বিতীয় বছর গেল। তৃতীয় বছরও যায়। ডাক্তার-কবিরাজ কিছু বাদ গেল না। শেখ পরিবারে মেঘের ছায়া। ঘটনা, রটনা। বাতাসে শত কথার ঢেউ।

হঠাৎ একদিন শোনা গেল—মমতাজের বিরাট সমস্যা: রাতে মমতাজের সঙ্গে নাকি সাপ থাকে, একটি নয়, দুটি সাপ। এক বিছানায় ঘুমায় তিনজন। মমতাজের পেটে বাচ্চা আসতে দেয় না এই সাপ যুগল। মমতাজকে সাপ দুটি ভালোবাসে। মমতাজের পেটে বাচ্চা এলেও নাকি তা কোনো মানুষের বাচ্চা আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। সাপের বাচ্চা আসবে, এক জোড়া সাপের বাচ্চা।

কথাগুলো বিশ্বাস করে শেখ পরিবার। কিন্তু সেলিম এসব কথা বিশ্বাস করে না, নিশ্চয়ই কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে; খুঁজে বের করতে হবে। সে শহরের বড় ডাক্তার দেখিয়েছে, কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। মমতাজেরও নাকি কোনো শারীরিক সমস্যা নেই! তাহলে?

বিয়ের চৌদ্দ বছরের মাথায় মমতাজের গর্ভে বাচ্চা এল—মানুষের বাচ্চা।
সবাই এবার নিশ্চিন্ত হলো, এটা ওঝার বদৌলতেই সম্ভব হয়েছে। অন্য জেলা থেকে ‘ওঝা’ ধরে আনা হয়েছিল, ওঝাও বলেছিল, ‘দুইটা সাপ ওরে মা হইতে দেয় না, তয় সাপ দুইটারে আমি বাক্সে ভইরা লইয়া যামু!’

এরপর আরও তিনবার মমতাজ মা হলো! সেলিম খুশি। সবাই খুশি। সুখী পরিবারের প্রতিচ্ছবি যেন।

৩.
বিষাদের ছায়া নেমে এল বিয়ের পঁচিশ বছরের মাথায়, সেলিম স্ট্রোক করে হাসপাতালে গেল। মমতাজের পৃথিবী এলোমেলো, দিশেহারাপ্রায়।
এ যাত্রায় বেঁচে গেল সেলিম।

হাসপাতালের তৃতীয় দিনের রাত। আশপাশে অন্য আর কেউ নেই, স্বামী-স্ত্রী দুজন। মমতাজ বেডের পাশে উঠে বসে, তারপর সেলিমের ডান হাতটি নিজের তালুবন্দী করে ঠান্ডা গলায় বলল, ডাক্তার বলেছে, কাল তোমাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারব, কিন্তু আজ তোমাকে...
মমতাজ কথা শেষ করতে পারে না, সেলিম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না, মম, এখানে আরও কটা দিন থেকে যেতে পারলে ভালো হতো!
—কেন?
—এখানে চব্বিশ ঘণ্টা তোমাকে পাশে পাই যে!
প্রতিদিনই কি তোমার কাছে বিয়ের দিন, হ্যাঁ?
—হুম।
-শোনো, তোমাকে আমার কিছু কথা বলার আছে...অনেক দিন ধরে বলব বলব করছি, কিন্তু বলতে পারছিলাম না, কিন্তু আজ তোমাকে বলতে চাই...নইলে আমার শান্তি হচ্ছে না...’
—আমি জানি, তুমি কী বলবে...!
—তুমি জানো?
—হুম, সব জানি...
—তুমি কচু জানো! যদি জানতে...তাহলে তো...
—আমি আজ কিছু শুনতেও চাই না, জানাতেও চাই না...আমি শুধু তোমাকে পাশে চাই...সব সময় তোমাকে জড়িয়ে থাকতে চাই!
—ওতে যে আমার শান্তি হচ্ছে না, আমার কথা আমাকেই বলতে দাও...’

সেলিম মমতাজকে আবার থামিয়ে দেয়। কাছে টানল। জড়িয়ে ধরল, তারপর মিহি গলায় বলল—আচ্ছা, ঠিক আছে, তোমাকে বলতে হবে না...তোমার মুখে শুনতে আমার ভালো লাগবে না...আমি তোমাকে অল্প করে বলি—বিয়ের আগে তুমি অন্য একজনকে ভালোবাসতে, বিয়েতে তোমার মত ছিল না, আমাকেও তোমার পছন্দ ছিল না, তুমি মা হতে চাওনি। কারণ, তখনো তাকে ভালোবাসতে, মনে মনে তাকে চাইতে, ভেবেছিলে সে তোমাকে নিয়ে চলে যাবে...তাই তো তুমি বুদ্ধি করে ‘সাপকাহিনি’ ছড়ালে...হা হা হা...

মমতাজ সেলিমকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল—সেলিম, তুমি...তুমি...
মমতাজের কথা এগোয় না। সেলিম বলে, হ্যাঁ, তোমার সেলিম, যে তোমাকে প্রথম দেখেই আল্লাহকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল, আমি তোমাকে হারাতে চাইনি, চুপ থেকে অপেক্ষা করে গেছি...জানো, তোমাকে আমি ভুল বুঝিনি, খারাপ ভাবিনি—তোমার মতো এত সুন্দর একটা মেয়ের প্রেমিক থাকবে না, তা হয় কী করে! আরও বেশি থাকলেও আমার সমস্যা ছিল না। আমি জানতাম, একদিন তুমি পেছনের কথা সব ভুলে যাবে আর আমাকেই শুধু ভালোবাসবে...
মমতাজ সেলিমকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, ভেজা গলায় বলে, ‘এবার আমি মরেও শান্তি পাব...মরেও শান্তি পাব, সেলিম...’
সেলিম মমতাজের ঠোঁট ঠোঁট রাখল। সময় নিল। তারপর ছেড়ে দিয়ে বলল, বুঝলে তো মম,‘তুমি আমার সাপিনী আর আমি তোমার সাপুড়ে’!

- রূপসা, খুলনা।