যোসেফ

গ্রামের নাম নয়নতারা। কি সুন্দর নাম। যেদিন ওর বস প্যাট্রিক ডি’কস্তার মুখে নামটি প্রথম শুনেছিল, সেদিনই এ গ্রামটি দেখার ইচ্ছে জেগেছিল যোসেফের। সে ইচ্ছেটা যে এমন নাটকীয়ভাবে পূরণ হবে সেটা কখনো কল্পনাও করেনি ও। তার বস অবশ্য বছর খানেক আগে বলেছিল, আমার একমাত্র মেয়ে শ্যামলীর বিয়ে, তোর কিন্তু যেতেই হবে যোসেফ। গ্রামের একদিকে নদী, আরেক দিকে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। নদীর নামটিও কত সুন্দর, ইছামতি। প্যাট্রিক ডি’কস্তার বাড়িটাও অনেক সুন্দর, পরিপাটিভাবে সাজানো। চার রুমের একটি একতলা বাড়ি। বাড়ির চারপাশ বিভিন্ন ফলের গাছ দিয়ে ঘেরা। এত বিচিত্র সব গাছ, সবগুলোর নামও জানে না যোসেফ। বাড়ির সামনে রয়েছে একটি মনোরম ফুলের বাগান। নানা জাতের, নানা বর্ণের ফুল ফুটে আছে। বাগান পেরিয়ে একটু সামনে গেলেই সরষে খেত। হলুদে হলুদময় হয়ে আছে জায়গাটা। আজ বিকেলেই বসের পরিবারের সঙ্গে বিশেষ করে শ্যামলীর সঙ্গে সরষে খেতে অনেকগুলো ছবি তুলেছে যোসেফ। যোসেফের ভাবতে অবাক লাগে, এত সুন্দর বাড়ি রেখে আন্টি কেন ফ্ল্যাট ভাড়া করে ঢাকায় থাকে। শ্যামলী ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, ও-তো ঢাকায় কোনো হোস্টেলে থাকতে পারে আর আন্টি শিপন, সুপন ওদের দুজনকে নিয়ে বাড়িতে থাকতে পারে। যোসেফের এ রকম সুন্দর একটা বাড়ি থাকলে ও কখনোই শহরে থাকত না। 

যোসেফের বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ছোটবেলায় মায়ের মুখে শুনেছে ওদের পূর্বপুরুষের বাড়ি নাকি বাংলাদেশের এই এলাকাতেই ছিল। মায়ের কথা মনে হতেই বুকের মধ্যে একটা চাপ চাপ কষ্ট অনুভব করে যোসেফ। ও ছিল বাবা–মায়ের একমাত্র সন্তান। কলকাতার শহরতলিতে ছোট্ট একটা বাড়ি ছিল ওদের। বাবা রেলওয়েতে চাকরি করত। বলা যায় মোটামুটি সুখেই ছিল ওরা। ছোটবেলা থেকেই যোসেফের ইচ্ছে ও ফাদার হবে, মণ্ডলীর সেবায় জীবন কাটিয়ে দেবে। একমাত্র সন্তান হওয়ায় বাবা–মা প্রথম দিকে রাজি হচ্ছিল না কিন্তু যেসেফের একাগ্রতার কাছে হার মানতে হয়েছিল তাদের। সপ্তম শ্রেণিতে উঠেই সেমিনারিতে প্রবেশ করে যোসেফ। কিন্তু বিধি বাম। যোসেফ যখন ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে, তখনই ওর মায়ের ব্রেস্ট ক্যানসার ধরা পড়ল। বাবা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, মায়ের সেবা করার কেউ নেই। সেমিনারি ছেড়ে যোসেফ বাড়ি চলে এল মায়ের সেবা করতে। টানা দুটি বছর মন–প্রাণ দিয়ে মায়ের সেবা–যত্ন করল যোসেফ। কিন্তু ক্যানসার নামের নিষ্ঠুর অসুখটা ওর সব সেবা–যত্নকে তাচ্ছিল্য করে, চিকিৎসাব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মাকে কেড়ে নিল ওদের কাছ থেকে, এ পৃথিবী থেকে।

মায়ের আচার অনুষ্ঠান শেষ করে সেমিনারিতে গেল যোসেফ। রেক্টর ফাদার বললেন—যোসেফ, অনেক বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে তোমার জীবনে। তোমার জীবনে একটা বড় বাধা এসে গিয়েছিল। আমি জানি না ঈশ্বর কী চান! তুমি বরং আরও কিছুদিন পরিবারের সঙ্গে থাক। মনটা ভেঙে গিয়েছিল যোসেফের।

মায়ের মৃত্যুর মাত্র এক বছর পরে, যোসেফ তখন কলকাতার একটা কলেজে বিএ পড়ে, বাবা নির্লজ্জের মতো যোসেফের বয়সী গরিব ঘরের একটি মেয়েকে বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে এল। আরও এক মাস পরে বাবার নতুন শ্বশুর–শাশুড়ি তাদের অপর মেয়েটিকে নিয়ে মেয়ে-জামাইয়ের বাড়ি এসে পাকাপোক্তভাবে নোঙর ফেলল। যোসেফ পড়ল বিপাকে। নতুন কুটুম্বদের তো আর অযত্ন করা যায় না। ছোট ছোট দুটি ঘর। একটিতে তার বাবা থাকে নতুন মাকে নিয়ে, অপরটি ছেড়ে দিতে হলো কুটুম্বদের জন্য। অগত্যা বারান্দায় মাদুর পেতে ঘুমাতে লাগল যোসেফ। কিন্তু শুধু ঘুমানো তো নয়, পড়াশুনা আছে, বিশ্রাম আছে, জামাকাপড় পাল্টানোর একটা ব্যাপারও তো আছে। ওকে এ বিব্রতকর অবস্থা থেকে বাবাই মুক্তি দিল। একদিন ওর কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে মিষ্টি করে বলল, বাবা যোসেফ, এ বাড়িতে তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে, আমি বুঝতে পারি। কিন্তু কী করব বল শ্বশুরবাড়ির মানুষ, তাড়িয়ে তো আর দেওয়া যায় না। তার চেয়ে তুমি এক কাজ করো, কলকাতার কোনো একটা হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করো। খরচ যা লাগে আমি দেব। বাবার বিয়ের পরই যোসেফ বুঝতে পেরেছিল এ বাড়ির ভাত ওর কপালে আর বেশি দিন নেই; কিন্তু সেটা যে এত তাড়াতাড়ি হবে তা ও ভাবতে পারেনি।

কলকাতায় হোস্টেলে থেকে ডিগ্রিটা পাস করে উপার্জনের ধান্দায় নেমে পড়েছিল যোসেফ। এরপর বছর খানেক পড়ে পাড়ি জমিয়েছিল মুম্বাই। মুম্বাই গিয়েই ক্যাটারিং কাজে হাতে খড়ি ওর। যোসেফ বুঝতে পেরেছিল ক্যাটারিং কাজ জানা থাকলে পৃথিবীর যেকোনো দেশেই চাকরি পাওয়া যায়। দুবছর পরই একটা হোটেলে চাকরি নিয়ে মুম্বাই থেকে দুবাই চলে যায় যোসেফ, আর ওখানেই পরিচয় ওই হোটেলের এক্সিকিউটিভ শেফ ওর বস প্যাট্রিক ডি’কস্তার সঙ্গে। প্যাট্রিক ডি’কস্তা লোকটা একদিকে ভীষণ শৌখিন, ফুর্তিবাজ আর দিলখোলা মানুষ; অন্যদিকে প্রচণ্ড রাগীও। যখন ভালোবাসে তখন আদর করে বুকে টেনে নেয়, কিন্তু রেগে গেলে হুঁশ থাকে না, মুখে যা আসে তাই বলে গালি দেয়। যোসেফকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসে তার বস। যোসেফের মনে পড়ে সেই রাতের কথা, যখন বাংলাদেশ থেকে দুঃসংবাদটা তার বসকে জানানো হলো টেলিফোনের মাধ্যমে। কাজ থেকে কোয়ার্টারে এসে তাস খেলছিল ওরা। হঠাৎ বসের মোবাইলটা বেজে উঠল। ও–প্রান্তের কথা শুনে বস শুধু দুবার বলল—কী বললা তুমি, কী বললা তুমি, আমি বিশ্বাস করি না। তারপর খাটে বসে পড়ল। মোবাইলটা পড়ে গেল হাত থেকে। দুহাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন প্যাট্রিক ডি’কস্তা। মোবাইলটা তুলে কানের কাছে নিয়ে হ্যালো বলল যোসেফ। ও–প্রান্ত থেকে পুরুষ কণ্ঠে একজন বললেন—প্যাট্রিকদা! যোসেফ বলল—না, আমি যোসেফ, ওনার সঙ্গে কাজ করি।

শোনেন, আমি প্যাট্রিকদার শ্যালক অসীম। আমাদের এখানে একটি বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, যে ছেলেটির সঙ্গে প্যাট্রিকদার মেয়ে শ্যামলীর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, সেই রাজু আজ সকালে রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে। প্যাট্রিকদাকে আপনারা একটু সামলে রাখবেন।

কিছুক্ষণ পর সান্ত্বনা দিতে গেলে যোসেফকে জড়িয়ে ধরে বস কাঁদতে কাঁদতে বলে—আমার সর্বনাশ হয়ে গেল রে যোসেফ। তিন দিন পার হয়ে গেল কিন্তু বস কিছুতেই¯স্বাভাবিক হতে পারছে না। কাজে যায় না, কারও সঙ্গে কথা বলে না। যোসেফ ওর বসের পাশে বসে বলল—বস, আপনার কষ্ট দেখে আর ভালো লাগে না। যদি পারতাম আপনার কষ্টের ভাগ নিতাম। প্যাট্রিক ডি’কস্তা যোসেফের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে—তুই সত্যি নিতে চাস আমার কষ্টের ভাগ?
- চাই, কিন্তু উপায় তো নেই।
- আছে, উপায় আছে।
- কীভাবে নিতে পারি আপনার কষ্টের ভাগ বলেন।
- তুই আমার মেয়ে শ্যামলীকে বিয়ে কর।
- তা কী করে হয়?
- কেন হয় না! আমার মেয়ে কি তোর যোগ্য নয়? কোনদিকে ওর কম আছে বল। যেমন সুন্দরী, তেমনি শিক্ষিতা, নম্র-ভদ্র।
- কিন্তু ওর তো একজনের সঙ্গে অ্যাফেয়ার ছিল, বিয়ে ঠিক ছিল।
- বিয়ে তো আর হয়নি, তাছাড়া সে-তো মারাই গেছে।
- কিন্তু আপনার মেয়ে কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে?
- সে দায়িত্ব আমার, তুই রাজি কি না বল?

যোসেফ রাজি হয়ে যায়। এর দুমাস পর বসের সঙ্গে চলে আসে বাংলাদেশে বসের বাড়িতে, বিয়ে করতে। আজ ডিসেম্বরের ২২ তারিখ। বড়দিনের পর ৩০ তারিখে ওদের বিয়ে।
- দাদা, চল আমরা ঘর সাজাই। ওর হবু শ্যালক শিপনের ডাকে বাস্তবে ফিরে আসে যোসেফ। এতক্ষণ ও বাগানে বসেছিল চেয়ার পেতে। সন্ধ্যা হয়েছে। ধীরে ধীরে হেঁটে ঘরে গিয়ে যোসেফ দেখে ঝালর, কাগজের শিকল আর বেলুন দিয়ে ঘর সাজানোর তোড়জোড় চলছে। শিপন, সুপনদের সঙ্গে তাদের দিদিও আছে। যোসেফও ওদের সঙ্গে হাত লাগায়। সাজানো প্রায় শেষের দিকে, শ্যামলী ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল—আমার সঙ্গে আসেন, কথা আছে। শ্যামলীর ঘরে গিয়ে খাটের ওপর পাশাপাশি বসে দুজন। শ্যামলী মেয়েটাকে এই কয়েক দিনে যতটুকু দেখেছে তাতে যোসেফের মনে ধরেছে। তবে এতটাই গম্ভীর হয়ে গেছে যে ওর সঙ্গে কথাই বলা যায় না। একটু সময় নিয়ে শ্যামলী বলে—আপনাকে একটি কথা বলা দরকার।
- কী কথা বলো?
- আমি কিন্তু প্রেগনেন্ট।
- প্রেগনেন্ট! কিন্তু তোমাদের তো বিয়ে হয়নি, এটা তো পাপ।
- আমি জানি। আমরাও চাইনি বিয়ের আগে ওসব হোক। কিন্তু মারা যাওয়ার আগের দিন কেন যে ও অমন বেপরোয়া হয়ে উঠল, এমন কাঙালের মত চাইল আমার কাছে, কাকুতি–মিনতি করল, আমি ওকে ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। জানি না, ও কি বুঝতে পেরেছিল যে ও আমাকে আর কোনোদিনও পাবে না! আমি আপনাকে ঠকাতে চাই না, তাই বললাম। এখনো সময় আছে, আপনি ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। জীবনটা আপনার, নিজের মনের সায় না থাকলে কারও মন রাখার জন্য কিছু করবেন না। আর একটি কথা, আমি কিন্তু আমার সন্তান নষ্ট করতে পারব না, কারণ ও আমাদের ভালোবাসার ফসল।

শ্যামলীর ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় যোসেফ। ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ছবির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। যিশুর দিকে তাকিয়ে বলে—আমি এখন কী করব প্রভু, আমাকে বলে দাও। আমি কি সারা জীবন শুধু ত্যাগ স্বীকারই করব? না, আমি চলে যাব। কাল ভোর হওয়ার আগেই আমি পালিয়ে যাব এখান থেকে।

আশ্চর্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও যোসেফের মন শান্ত হচ্ছে না। অবশেষে ওর সারা জীবনের সঙ্গী, সমস্ত দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা যার সঙ্গে শেয়ার করা যায়, যেখানে উত্তর মেলে অনেক জটিল প্রশ্নের, সেই বাইবেল নিয়ে বসল যোসেফ। বাইবেল খুলতেই ওর চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল মথি লিখিত সুসমাচারের ১ অধ্যায়ের ২০ পদ ‘দায়ূদের বংশধর যোসেফ, মরিয়মকে বিয়ে করতে ভয় কোরো না, কারণ তাঁর গর্ভে যিনি জন্মেছেন তিনি পবিত্র আত্মার শক্তিতেই জন্মেছেন...।’
যোসেফের মনে আর কোনো দ্বিধা নেই, ভয় নেই, যন্ত্রণা নেই। বাইবেল চুম্বন করে যথাস্থানে রেখে শ্যামলীর ঘরে যায় যোসেফ। শ্যামলী খাটে বসে আছে আনমনে। যোসেফ শ্যামলীর দিকে তাকিয়ে বলে—শ্যামলী, চলো কাল সকালে আমরা গির্জায় যাই। দুদিন পর বড়দিন, তারপর আমাদের বিয়ে, আমাদের দুজনেরই পাপ স্বীকার করা দরকার।

শ্যামলী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে যোসেফের দিকে। তবে বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না, চোখের জল লুকাতে অন্য দিকে মুখ ঘুরায়।