কুকিজ

বরাবরই একা জার্নি আমার ভালো লাগে না। কলকাতা নেমে ঘণ্টা তিনেক বসতে হবে মুম্বাইয়ের ফ্লাইট ধরতে। ভেবেছিলাম এয়ারপোর্টে ফ্রি ওয়াইফাই পাব। ছেলে, স্বামীর সঙ্গে কথা বলব। জানলাম লোকাল কোনো মোবাইল অপারেটরের সিম থাকতে হবে। মনটা ভীষণ মেঘলা হলো।

মেঘলা মনে মুম্বাইয়ের ফ্লাইট ধরলাম। অন্ধকার আকাশ প্রিয়জনের জন্য মনটাই বিষাদ ছেয়ে দিল। অনলাইনে রাখা মুভিতে মন ডুবিয়ে নাকে খাবারের ঘ্রাণে পেটের টান বুঝতে পেলাম। কেবিন ক্রুদের হাতে লিস্টি, আর সেই লিস্ট ধরেই খাবার দেওয়া হচ্ছে। বুঝে উঠতে পারলাম না বিষয়টি কী। লিস্ট কেন, তবে সেই লিষ্টে আমি আছি কি না। ঠিক এই ভাবনার মধ্যে দ্রুত বাড়তে থাকল খিদে। ব্যাগে ঢাকা থেকে আসার সময় ফ্লাইটের এক টুকরো কুকিজ রেখে দিয়েছিলাম। মনে হলো যাক বাবা বাঁচা গেল। সামলে নেব ব্যাটা খিদেকে। হঠাৎ দেবদূতের মতো কেউ একজন বলল, ‘ভেজ, না ননভেজ?’। ননভেজ বলতে বলতে মনে হলো আহা! ঠিক তখনই পেছনের সিট থেকে বয়স্ক একটা কণ্ঠ বলল, ‘আমাদেরটা?’ ক্রু বলল, ‘আপনাদের কমপ্লিমেন্টারি খাবার নেই, কিনতে হবে, অপেক্ষা করুন আসছি।’ আমি খাওয়া শুরু করলাম। আমার খাবার প্রায় যখন শেষ, তখন ভদ্রলোক খাবার অর্ডার করলেন। বাদ সাধল পেমেন্ট নিয়ে। ক্রুরা কার্ডে পেমেন্ট চাইছেন, আর ভদ্রলোক বলছেন, ‘I can pay only cash, I don’t have any card.’ ক্রুরা বললেন, ‘সরি, অপশন নেই, কমপ্লিমেন্টার চা–কফি ছাড়া কিছু পারছি না।’ এবার আমি তাকালাম। ৭০ বছর হবে ভদ্রলোকের, তিনি রেগে গেলেন, বললেন, ‘ডিনার টাইমে চা–কফি? আপনাদের উচিত ছিল যাত্রীদের ইনফর্ম করা।সেই বাংলাদেশ থেকে আসছি...এতদূর যাব।’ পাশের আরেকটা রো–তে একই সমস্যা। যতদূর বুঝলাম টিকিট বুক করার সময় খাবারের অপশন বাদে বুক করা হয়েছে, যা এই ভদ্রলোক জানেনই না। নামী এয়ারলাইনস, কত–কী তাদের অপশন।

ভদ্রলোকটির জন্য কষ্ট লাগছিল। পরে বুঝলাম সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও আছেন। এই প্রথম খাবার খেয়ে অস্বস্তি লাগল। মনে হলো কেন খেলাম জলদি। না হলে হয়তো...। নিজের বাবা, মা, শাশুড়ি মায়ের কথা মনে হচ্ছিল। খিদে পেলে ওনারা কী অস্থির হন। মাথাটা ভন ভন করছিল। হঠাৎ মনে পড়ল কুকিজের প্যাকেটের কথা। অনেক সংকোচ নিয়ে পিছু ফিরে বললাম, ‘কুকিজ আছে নেবেন?’ ভীষণ রেগে ছিলেন বা অপমানিত বোধ করেছিলেন বলে উনি আমার কথা বুঝতে পারছিলেন না। তারপর প্যাকেট বাড়িয়ে বললাম, ‘প্লিজ নিন’ উনি বললেন, ‘কুকিজ?’ ভীষণ খুশি হয়ে নিলেন। আমার চোখে পানি এল, যখন উনি সেটি ওনার স্ত্রীকে দিয়ে বললেন, ‘খাও’। কী এক ভালো লাগা, ভালোবাসায় আমার মেঘলা মনটা দুলে উঠল। মনে মনে ভাবলাম যাক। ফ্লাইটে কুকিজটা না খেয়ে ভালোই করেছি।

 লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ