অমরত্বের ছায়া

দুর্গন্ধে আর থাকতে পারল না পরশ। ডান কাঁধের কাছে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করল সে। উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তারপরও কিছু করার নেই; তাকে যে উঠতেই হবে। তা না হলে এই পচা গন্ধে তার দম বন্ধ হয়ে যাবে। সূর্যের তীব্র আলোয় চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে। আশপাশটা তাকানোর সুযোগ না দিয়ে অতি কষ্টে গর্ত থেকে উঠে এল রাস্তায়। এরপর ফিরে তাকাল গর্তের দিকে।

আঁতকে উঠল সে। আহ্! একি? গর্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে অসংখ্য লাশ, কিছু বিচ্ছিন্ন হাত-পা। উফ্! আর দেখতে পারল না পরশ। মনে মনে ভাবল, এ আমি কোথায় এলাম? কোথায় আমার ঘর, করবী আর আমার মেয়ে ছোঁয়া? সবকিছু কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কোনো কিছু মনে করতে পারছে না কেন সে! ব্যথার জায়গাটায় তাকালে। রক্তে লাল হয়ে আছে শার্টটা। মনে পড়ল পাকিস্তানি সেনাদের গুলির শব্দ। কিন্তু তারপর? তারপর কী হলো মনে পড়ছে না কেন তার? আর কেনই-বা গুলি করল?

রাস্তার পাশ থেকে বড় একটা লাঠি তুলে নিল। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে তার সুবিধে হচ্ছে। এখানকার রাস্তাঘাট কেমন যেন অপরিচিত মনে হচ্ছে। বেশ দূরে রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান। পরশ দোকানদারকে রাস্তার নাম জিজ্ঞেস করল। দোকানদার কোনো উত্তর দিল না। পরশ ভাবল, এ কেমন মানুষ? তৃষ্ণায় গলাটা শুকিয়ে গেছে। এক গ্লাস পানি চাইল সে। দোকানদার তার কথা কানেই তুলল না। একটু অবাক হলো পরশ। দেরি না করে সেখান থেকে আবার হাঁটতে শুরু করল। চারপাশটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। কোনো রিকশা-গাড়ি চলছে না। একটু সামনে একটা রিকশা দেখতে পেল। কাছে যেতেই কষ্টে হৃদয়টা দুমড়ে-মুচড়ে গেল। দেখল রিকশার ওপর একজনের রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, কেউ যেন ধারালো কিছু দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। ইশ্‌! কী বীভৎস মৃত্যু! রিকশার পেছনে ছোট করে লেখা রায়েরবাজার। নামটা পরশের চেনা মনে হলো। নিজের ভাবনাটায় একটু জোর দিল। মনে পড়ে গেল সবকিছু। ধানমন্ডিতে স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে থাকত। ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের টিচার সে। মনে পড়ে গেল যুদ্ধ। হ্যাঁ, মুক্তির জন্য যুদ্ধ, স্বাধীনতাযুদ্ধ। রাতে হঠাৎ পাকিস্তানি সেনারা তাকে ঘর থেকে জোর করে নিয়ে আসে রাস্তায়। তারপর চোখ বেঁধে কোথায় যেন নিয়ে যায়। পরশের মনে পড়ে গেল সবকিছু। এবার শুধু ঘরে ফেরার পালা।

অনেকটা হেঁটে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে পরশ। এদিকে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে শরীরের বলটুকুও শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে যে হার মানলে চলবে না। চোখের সামনে স্ত্রী-কন্যার মুখটা ভেসে উঠল। আবার শক্ত মনোবলে হাঁটতে শুরু করল সে। রাস্তার পাশে একটা কুকুর ও কতগুলো কাক কী যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। একটু ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারল, একটা মৃত মানুষের অংশবিশেষ। বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। ভাবল, আমার ঘরে ওরা ভালো আছে তো! জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডের কাছে এসে দাঁড়াল। রাস্তায় দু–একজন মানুষ দেখা যায়। কিন্তু তারা কেউ পরশের দিকে ফিরেও তাকালে না। পরশ আবারও অবাক হলো। একজন রক্তাক্ত মানুষকে দেখে কি ওদের মায়াও হয় না?

নিজের বাসার দরজায় এসে দাঁড়াল পরশ। দরজা খোলা, ভেতরে অনেক কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ভেতরে গিয়ে দেখে বেডরুমের বিছানায় ছোঁয়া ঘুমাচ্ছে। সিটিং রুমে করবী তার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আশপাশে সোফায় আরও আত্মীয়স্বজন বসে আছে। সবার মুখ মলিন। পরশ সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু অবাক কাণ্ড! কেউ তাকে যেন দেখলই না। করবীর কাছে গিয়ে হাতটা ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুই হলো না। করবী তার স্পর্শ অনুভব করতে পারল না। পরশ এবার বুঝতে পারল যে এই মর্ত্যলোকে তার দিন ফুরিয়েছে অনেক আগেই। দেহ পড়ে আছে রায়েরবাজারের সেই দুর্গন্ধময় গর্তে। শুধু তার অশান্ত ছায়া ছুটে এসেছে আপনজনদের কাছে। সবার কথা শুনে বুঝতে পারল, দেশ স্বাধীন হয়েছে দুই দিন আগে। পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছে। খুশিতে প্রাণটা ভরে উঠল পরশের। স্বাধীনতার এই খুশি যেন তার দেহ হারানোর সব গ্লানি ধুয়ে-মুছে দিয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে—এর চেয়ে বেশি কিছু তো তার চাওয়ার নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এ দেশের মাটিতেই তার ছায়া অমর হয়ে থাকবে চিরকাল।

সদস্য: ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা