খুন হওয়া চিঠি

বিক্ষিপ্ত আয়নার মতো টুকরা টুকরা হয় আমার দিনগুলো। এক মনে ভাবি, তার সঙ্গে কথা বলা উচিত; আরেকবার মনে হয়, কী পেতে চাই আমি তার কাছ থেকে? সুনির্দিষ্ট কিছু কি চাওয়ার আছে আমার? আচ্ছা, কোনো কিছু যদি না–ই চাওয়ার থাকে, তাহলে সমুদ্রভাঙা ঢেউয়ের মতো চাপা কষ্টগুলো বুকজুড়েই–বা আছড়ে পড়ে কেন!

এটা ঠিক যে ‘ভালোবাসা’ আজ আর চাওয়ার নেই আমার। কিন্তু আপমান–আঘাত সই কেমন করে।
প্রিয়জনের কাছ থেকে ভালোবাসা না পাওয়াটা যতটা দুঃখের, অপমান আর অবহেলা পাওয়াটা তার চেয়েও ঢের দুঃখের।
‘আঘাত যে পুষে রাখতে চায়, ব্যথার শাস্তি তার চিরদিনের।’ কিন্তু ব্যথা তো আমি পুষে রাখতে চাইনি। এই যে অলকনন্দার গাছগুলো হলদে ফুলে ফুলে ভরে থাকে, আমি চেষ্টা করি যেন সে ফুলগুলো শোককাতর না হয়। চেষ্টা করি এই রাতগুলোর যেন করুণ রাগে না গাইতে হয় বিষাদের সুর। চেষ্টা করি যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে। মাঝেমধ্যে লুকিয়ে দুচোখ শুধু ভিজে যায় বৃষ্টি এলে। কে বেশি বৃষ্টি নামায়—খোলা আকাশ, না আমার দুচোখ? 
ওর নিরুত্তাপ কথাবার্তা আর উদাসীনতা বুকে যে লাগে! অতলান্তে ডুব দিলে দেখি অতি চেনাজন, অথচ মুহূর্তেই কত দূরের মানুষ সে। 
ইতস্তত আমি সব দুয়ার এক এক করে খুলতে খুলতে বুঝতে পারি, এ অভীপ্সা আমার খুন হয়ে যাওয়া চিঠির মতো। যে চিঠি কখনো প্রাপকের হাতে পৌঁছায় না। 
পড়েছিলাম, ‘কাউকে প্রচণ্ডভাবে ভালোবাসার মধ্যে একধরনের দুর্বলতা থাকে, তখন নিজেকে তুচ্ছ আর সামান্য মনে হয়, এটা ছোট করে দেয় নিজেকে।’ হয়তো তাই; আমি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হতে থাকি। আদিগন্ত আকাশজুড়ে অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে শূন্য হয়ে পড়ি, পরিযায়ী পাখিদের ঝাঁক থেকে দলছুট হয়ে পড়ি আমি। আর ওকে মনে হয় যোজন যোজন দূরের মানুষ, যাকে জয় করা কঠিন। 
‘আমি আসব?’ কিংবা ‘চলো, আজ একসঙ্গে হাঁটি’—এসব স্বাভাবিক কথা চালাচালিতেও আজ বড্ড ভয় করে, পাছে ও অন্য কিছু ভেবে বসে! নিজের মধ্যেই প্রতি পলে মিইয়ে যাই কর্পূরের মতো। রেলিং ধরে তিমির রাত নামতে থাকলে নিজেকে রোজ লুকোতে চেষ্টা করি সে রাতের আড়ালে।