চট্টগ্রাম টু ভৈরব

ট্রেন ভ্রমণে চট্টগ্রাম বন্ধুসভার সঙ্গে লেখক
ট্রেন ভ্রমণে চট্টগ্রাম বন্ধুসভার সঙ্গে লেখক


যাত্রার দিনটি ছিল শুক্রবার। চট্টগ্রাম বন্ধুসভার আমরা পাঁচজন রওশন ভাইয়ের আমন্ত্রণে চট্টগ্রাম থেকে ভৈরবের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। রাত সাড়ে ১২টায় ট্রেন। স্টেশনে অনেকেই আসেন আমাদের বিদায় জানাতে। স্টেশন লোকারণ্য ছিল। কুলিদের হাঁকডাক, হকার-ফেরিওয়ালাদের চেঁচামেচিতে পুরো স্টেশন মুখর। টিকিট আগেই কাটা ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেন এল। আমরা ট্রেনে উঠে পড়ি। আমি জানালার পাশে বসলাম। ঝকঝক শব্দে ট্রেন এগিয়ে চলছে। প্রথমে ধীরে, পরে দ্রুতগতিতে। যখন ভৈরব পৌঁছালাম, তখন প্রায় ভোর। ভৈরব বন্ধুসভার বন্ধুরা আগেই আমাদের জন্য হোটেলে রুমের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন এবং একজন বন্ধু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হোটেলের সামনে গিয়ে দেখি দরজা বন্ধ। অনেক ডাকাডাকির পর বন্ধুটির ঘুম ভাঙে আর দরজা খুলে দেন। তাঁর ভাষ্যমতে, তিনি সারা রাত জেগেছিলেন আমাদের অপেক্ষায়। আমরা আসার একটু আগেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এরপর যে যার রুমে গেলাম। এই ভ্রমণে যেহেতু আমিই একমাত্র নারী, তাই আমার জন্য একটি রুম বরাদ্দ ছিল। সবাই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। পরে শুনেছি, সবাই ঘুমিয়েছিলেন। কিন্তু আনন্দ আর উত্তেজনায় আমার ঘুম আসেনি। আমার প্রতি সবার নির্দেশ ছিল, যেন দেরি না করি। অথচ আমাকে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলো সবার জন্য। এরপর সবাই মিলে চলে যাই অনুষ্ঠানস্থলে। বন্ধুসভার জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ ও ভৈরব বন্ধুসভার আয়োজনে ‘পাঠক পার্বণ’ শিরোনামে ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের মূল উপজীব্য ছিল ‘বই পড়ি মন গড়ি’। শুরুতেই বই হাতে সবাই আজীবন বই পড়ার শপথ নিই। শপথ পড়ান জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি। আমার হাতের বইটির নাম ছিল ঢাকার প্রাচীন ইতিহাস। সবাই একসঙ্গে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করি। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম বন্ধুসভার সভাপতি শিহাব জিসান ও ভৈরব বন্ধুসভার সাহিত্য সম্পাদক রাসেল আহমেদ মোল্লা। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে ছিল বিভিন্ন বন্ধুসভার বন্ধুদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। আমাদের চট্টগ্রাম বন্ধুসভার বন্ধু ফয়সাল জাদু প্রদর্শন করেন। অনুষ্ঠানের ফাঁকে অনেকের সঙ্গে মঞ্চে আমাকেও ডাকা হয়। আমার কাছে প্রশ্ন ছিল, ‘বই সুন্দর না বউ সুন্দর? আমার উত্তর ছিল, ‘দুটিই সুন্দর। তবে যদি তুলনা করতেই হয়, তবে বই সুন্দর। কারণ, বই পড়ে ভালো মানুষ হওয়া যায়।’ তা ছাড়া অনুষ্ঠানজুড়ে ছিল বই আলোচনা। বিকেল চারটায় অনুষ্ঠানটি শেষ হয়।
এরপর সব বন্ধু মিলে যাই মেঘনা নদীর ঘাটে। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নদীর ওপর মেঘনা-গোমতী সেতু। একই সঙ্গে এই নদীর ওপর রয়েছে ভৈরব রেল সেতু। নদীর পানিতে সেতুর ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম বাতির আলোর প্রতিফলন যেন কোনো এক রাজকন্যার কানে গাঁথা ছোট ছোট দুল। সেই আলোর প্রক্ষেপ খুব মায়াবী। আমরা সবাই এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। অবশেষে গভীর আন্তরিকতায় সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা পাঁচজন হেঁটে শহরটি ঘুরে দেখি। এখানকার রিকশাগুলো খুব সুন্দর। ভৈরবের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ সচল। নারীরা ঘরের কাজের পাশাপাশি দোকান সামলান। এখানকার সবচেয়ে মজার খাবারের মধ্যে মাছ আর তালের বড়া জনপ্রিয়। এখানে এসে কিছু আঞ্চলিক শব্দ শিখেছি। ‘এনো’—যার অর্থ এখানে; ‘ছেরা’—যার অর্থ ছেলে। এবার বাড়ি ফেরার পালা। ট্রেনের অপেক্ষায় আমরা রেলস্টেশনে। তানভীর অনেক জল্পনাকল্পনা করে একটি জায়গা নির্ধারণ করলেন, যেখানে আমাদের কাঙ্ক্ষিত বগি স্থির হতে পারে। কিন্তু ট্রেন যখন আসে, তখন দেখি আমাদের বগি অনেক দূরে। সবাই মিলে দিলাম দৌড়। ছুটতে গিয়ে আমার ব্যাগের প্রিয় ঝুনঝুনিটি হারিয়ে ফেলি। ভিড় ঠেলে ট্রেনে উঠতেই তাসফিক ওর পকেটে অন্য একজনের হাত টের পায়, পকেটমার। সব সামলে সিটে গিয়ে বসলাম। তখনই একজন বৃহন্নলা এসে টাকা চাইলেন। নাম বিজলী। সবাই ঘুমের ভান করে ছিলাম। কিন্তু শিহাব ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়েই ছাড়ে। সবাই অনেক মজা করি সারা রাত। পরের স্টেশনে বিজলীকে নেমে যেতে দেখি। যতক্ষণ দেখা যায়, ততক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সমাজে এসব অবহেলিত মানুষের জীবন কত করুণ। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি, আকাশের গায়ে ফুটে উঠেছে হাজারও তারার আলোক–স্পন্দন। ট্রেন চলছে, বাইরের দৃশ্যগুলো দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। রাতের আঁধার দেখে মনে হয়, সবাই যেন এক সুগভীর অন্ধকারের দিকে ছুটে চলেছি। সে এক অপার্থিব অনুভূতি।