হজা ভাই

গ্রাম: স্বপন চারুশি
গ্রাম: স্বপন চারুশি


আমাদের বাড়ির সামনে হজা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো।  হজা ভূঁইয়া। বাম হাতে লাঠি। তিনি তাঁর বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। গায়ে সোয়েটার। তার ওপরে জ্যাকেট। চুল, দাড়ি, গোঁফ সবই কাঁচা-পাকা।
আমরা যখন ছোট, তখন হজা ভাই নৌকা চালাতেন। নৌকার মাঝি। আমরা বলতাম, ‘কেরাই নাও।’ বিশেষ করে বর্ষায় নৌকা ছাড়া উপায় ছিলে না। তারপর আস্তে আস্তে বর্ষা কমে আসতে লাগল। কাশিয়াখালী নামক জায়গায় দেওয়া হলো বেড়িবাঁধ। পদ্মা নদীর মুখ বন্ধ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগল আমাদের প্রাণের ইছামতী নদী।
বর্ষাকাল মানেই পুরো গ্রামে পানি। বাড়িগুলো যেন ছোট ছোট দ্বীপ। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যেতে লাগে নৌকা। আমাদের ছিল একটি ‘কোষা’ নৌকা। সেই নৌকায় আমরা এবাড়ি-ওবাড়ি যেতাম। সেই নৌকা নিয়ে যেতাম দাউদপুর বাজারে কিংবা বারুয়াখালী অথবা বান্দুরা হাটে।
যাদের নৌকা ছিল, তাদের বড়লোকই বলা হতো। সচ্ছল। আর যাদের নৌকা ছিল না, বর্ষাকালে তারা একরকম বন্দীই থাকত বাড়িতে। অন্যের নৌকায় হাট-বাজারে যেত। আমরা চার–পাঁচজন মিলে নৌকা বেয়ে যেতাম শিকারীপাড়া স্কুলে। আমাদের গ্রাম বকচর থেকে চার কিলোমিটার দূরে। সবার হাতেই থাকত বইঠা। নৌকা নিয়ে নির্ধারিত সময়ে আমাদের স্কুলে পৌঁছাতে হতো।
হজা ভাইয়ের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। তিনি আমার বাঁ হাত ধরে টেনে রাস্তার পাশে দাঁড় করালেন। আমাদের পাশ কেটে একটি ইজিবাইক চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে আবার আমাদের পাশ দিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল একটি নতুন মোটরসাইকেল। তারপর পাশ কেটে চলে গেল একটি দেড় টনি ট্রাক।
মনে পড়ল আমার ছোটবেলার কথা। আমাদের বাড়ির সামনে এই রাস্তা দিয়ে রাখালেরা গরু-বাছুর চরাতে নিয়ে যেত দূরের মাঠে। আবার গরুর পাল নিয়ে ফিরে আসত গোধূলি বেলায়। গরুর পালের পেছনে পেছনে থাকত দু–চারটি ভেড়া। ওদের গলায় কোনো দড়ি থাকত না। ওরা নেচে নেচে গরুর পালের পেছনে ছুটত।
সে সময় গ্রামের সরু রাস্তাগুলোকে বলতাম হালট। হালট শব্দটি ঢেঁকি শব্দের মতো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন বলি রাস্তা। জানা গেল আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটি পাকা হবে। ইট বিছানো হবে। এখন কেউ কেউ রাস্তাটিকে সড়ক বলে। একসময় সড়ক শব্দটিও হয়তো উঠে যাবে। রাস্তাটির নাম হবে হয়তোবা বকচর রোড।
হজা ভাই আমাদের বাড়ির দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘বাড়িটা মেরামত করো। নতুন ঘরটর দেও। খারাপ দেখা যায়।’ আমাদের বাড়িটির নড়বড়ে অবস্থা। কখন যেন ভেঙে পড়ে!
হজা ভাইয়ের কথা শুনে লজ্জা পেলাম। আধা ঘণ্টা আগেই আমি আমার ১০ বছরের ছেলেকে নিয়ে প্রায় পুরো গ্রাম চক্কর দিয়েছি। ৮০ শতাংশ বাড়িতেই পাকা ঘর। অ্যাটাচ বাথরুম। টয়লেট, ছোট একটি গ্রামে তিনটি দোতলা বাড়ি। আমার দেখা ছোটবেলায় সেই বাড়িগুলো ছিল শণ দিয়ে ছাওয়া বা টিনের ঘর।
গ্রামে আমরা কয়েক ‘ঘর’ ছিলাম ভদ্রলোক। সেই সময়ের ভদ্রলোকের একটা ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন। যাঁরা চাকরি করতেন, তাঁদের বলা হতো ভদ্রলোক বা মিয়া। আমরা ছিলাম মিয়াদের দলে।
আর যাঁরা ছিলেন দিনমজুর বা কামলা কৃষক, চাষি, তাঁদের সেই দলে ফেলা হতো না।
হজা ভাইকে বললাম, ‘কেমন আছেন?’
‘ভাই, দুই পায়ে ব্যথা, হাঁটতে পারি না। জানোই তো পাঁচ বছর ধইরা বইসা পেশাব করতে পারি না। দাঁড়াইয়া কাম সারতে অয়। কী করুম। কী অসুখ যে হইল। মিটফোর্ড হাসপাতালে গেছিলাম কয়েকবার। কাজ অয় নাই। বসতে পারি না।’
হজা ভাইয়ের স্ত্রী মারা গেছেন কয়েক বছর হলো। দুই ছেলে বিবাহিত। এক ছেলে মধ্যপ্রাচ্যে। আরেক ছেলে ঢাকার একটি ছোটখাটো হোটেলে কাজ করেন।
বললাম, ‘থাকেন কার কাছে?’
‘আর বইল না, ভাই। ভাতের অভাব নাই। যে বাড়িতেই যাই, খাওন দেয়। কিন্তু আমারে দেহার কেউ নাই।’
হজা ভাই লাঠি ভর দিয়ে বাড়ির দিকে গেলেন। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কী সবল দেহ ছিল তাঁর। হাতে সেগুন কাঠের বইঠা নিয়ে নৌকা চালিয়ে আমাদের নিয়ে যেতেন বান্দুরা। বান্দুরা ছিল লঞ্চঘাট। সেই ঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে যেত ঢাকার দিকে। আমি একের পর এক স্টেশনের নাম মুখস্থ করতাম। বান্দুরার পরই গোল্লাস্টেশন। তারপর ধাপারি, তারপর কলাকোপা, নবাবগঞ্জ, কক্সনগর, কোমরগঞ্জ, কৈলাইল। তারপর লম্বা যাত্রায় লঞ্চ পৌঁছে যেত ফতুল্লা স্টেশনে। আমরা রোমাঞ্চিত হতাম। সদরঘাটের দিকে চেয়ে। আহ কী মজা, ঢাকা শহরে পৌঁছে যাচ্ছি।
একদিন লোকজনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে বাইরে দেখি হজা ভাইয়ের মাথায় বিরাট এক বোঝা। বোঝাটি মাথা থেকে নামাতেই দেখি আমাদের বড় রেডিওটা।
আমাদের গ্রামে প্রথম রেডিও আসে আমাদের বাড়িতেই। রেডিও নষ্ট হয়েছিল বলে সেটা সারাই করতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ঢাকায়। হজা ভাই ‘গয়নার নাও’–এ করে রেডিও নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকায়। আমাদের গ্রাম থেকে গয়নার নাও (বড় ছইওয়ালা নাও) ছাড়ত সন্ধ্যাবেলায়। সেটা সদরঘাট পৌঁছাতে পরের দিন সকালবেলা।
আমরা বাড়ি থেকেই গয়নার নৌকার মাঝিদের হাঁকডাক শুনতাম, ‘এ্যাই ঢাকা। ঢাকা।’
সম্ভবত রেডিওতে সাপ্তাহিক নাটক হতো। নাটক হতো অনেক রাতে। সেই নাটক শোনার জন্য যে কত দিন রাত জাগার চেষ্টা করেছি। পারিনি। পরের দিন সকালে উঠে মাকে বলেছি কেন আমাকে জাগালে না।
আব্বা চাকরি করতেন কলকাতায়। এক বছর, দেড় বছর পরপর বাড়িতে আসতেন। বাড়ির বারান্দায় বসে থাকতেন। গ্রামের ছোটরা অনেকে চিনতই না তাঁকে। জিজ্ঞেস করত, ‘লোকটা কে রে?’ আমি বেশ মজা পেতাম। আবার কষ্টও হতো। আবার কেউ কেউ জানত আমার বাবা নেই।
মনে পড়ে বাবার হাত ধরে রথের মেলায় গিয়েছিলাম গউদপুর বাজারে। লটকন, চানাচুর, মুরালি ও সোলার বানর কিনে দিয়েছিলেন আব্বা।
আমার কাকা চাকরি করতেন ঢাকায়। বাবার চাচাতো ভাই। চাকরি করতেন কুঠি বাড়িতে। সাহেব বাড়ির খানসামা হিসেবে। তিনি বাড়ি ফিরতেন ঢাকা থেকে লঞ্চে কালিগঙ্গা নদী দিয়ে। বালুখণ্ড ছিল লঞ্চঘাট। সেখান থেক‌ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বাড়িতে ফিরতেন প্রায় প্রতি মাসে। সঙ্গে নিয়ে আসতেন নানা রকম খাবার, বিস্কুট।
আমরা ভাইবোনেরা কাকার উঠোনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আমাদের সবার হাতে চাচি তুলে দিতেন নানান রকম খাবার। আহা সে কী অমৃত!
হজা ভাই অনেক দূরে চলে গেছেন। আমরা হাঁটছি গ্রামে। সঙ্গে আমার এক চাচাতো ভাই হীরক। আমি এক মহিলাকে দেখলাম লাউয়ের জাংলার নিচে বসে মোবাইলে কথা বলছেন।
আমি হীরককে বললাম, ‘এত কী কথা কয় রে মহিলা।’
হীরক উত্তর দিল, ‘ওনার স্বামী ইতালি থাকে। মনে হয় হের সঙ্গেই কথা কইতেছে।’
মনে মনে বলি এ কী বিস্ময়। আমাদের গ্রামটা ইতালি পৌঁছে গেছে।