উড়োজাহাজের উড়ো চিঠি

প্রবাসে শামীম শাহেদ (বামে)।
প্রবাসে শামীম শাহেদ (বামে)।


সঙ্গে বাচ্চা থাকলে অনেক সুবিধা। বিশেষ করে প্লেন জার্নিতে। এয়ারপোর্টে আপনি হয়তো দাঁড়িয়ে আছেন, সামনে লম্বা লাইন। বাচ্চাদের দেখলেই বলবে, আফটার ইউ। আফটার ইউ। ইউরোপের সব জায়গাতেই আমরা এটা দেখেছি। ভেবেছিলাম, আমাদের দেশে এটা হবে না। এখানে বাচ্চা কি আর বড় কি, সবাইকে ধাক্কাধাক্কি করে তার জায়গা নিতে হয়। কিন্তু বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলাম, এখানেও বাচ্চাদের বিষয়টি সবাই বিশেষ যত্নের সঙ্গে দেখল। আমাদের আগে দিয়ে দিল। আমরা কাউন্টারের কাছাকাছি চলে এলাম। বাঁ দিকে কাচের দেয়ালের ঠিক ওপারেই কাতার এয়ারওয়েজের বিরাট একটি প্লেন দাঁড়ানো। আমরা সবাই বেশ উত্তেজিত। ইউরোপ যাচ্ছি। সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি। লম্বা প্ল্যান।
‘আপনারা কি প্রথমে সুইডেন যাচ্ছেন, নাকি কোপেনহেগেন?’ প্রশ্ন করলেন কাতার এয়ারওয়েজের কাউন্টারে বসে থাকা সাফকাত সাহেব। ভদ্রলোককে দেখে কেমন যেন চিন্তিত মনে হলো।
‘কোপেনহেগেন। কেন, কোনো সমস্যা?’
‘একটা সমস্যা আছে।’
‘কী সমস্যা বলেন তো।’
ভদ্রলোক একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘আপনাদের ভিসা নাই।’
আমি ঘামতে শুরু করলাম। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। ‘বলেন কি। ভিসা নেই মানে? এত দূর এলাম কী করে? লাগেজ শিফট করলাম, বোর্ডিং পাস নিলাম, ইমিগ্রেশন করলাম, একটু পরে প্লেনে উঠব, আর আপনি এখন বলছেন ভিসা নেই। এটা কীভাবে সম্ভব?’
মুন খুব একটা টেনশন নিতে পারে না। একটু টেনশনে পড়লেই তার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বেশি টেনশনে পড়লে ফাম্বল করতে শুরু করে। এখনো ফাম্বল শুরু করে দিল। ‘উ...উ...উনি কী বলছেন এসব। আ...আ...আমাদের ভিসা নেই মানে!’
‘এত টেনশনের কি আছে? দেখা যাক।’ আমি মুনকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম।
সাফকাত সাহেব আমাদের ইশারায় পাশে ডাকলেন। ‘আসুন আমার সঙ্গে, বিষয়টি বুঝিয়ে বলছি।’
পাথরের মতো তাকে অনুসরণ করলাম। অরোরা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে প্রশ্ন করল, ‘মা, আমরা কখন প্লেনে উঠব?’ কেউ কোনো উত্তর দিল না। মান–ইজ্জতের ব্যাপার।

‘দেখুন, ভুলটা আপনাদের না। ভুলটা সময়ের।’ সাফকাত সাহেব বলছেন, আমরা তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। ‘আপনাদের পাঁচজনের ভিসা শুরু ২৪ জুলাই থেকে। একজনের ২৫ জুলাই। আপনারা যখন কোপেনহেগেন নামবেন, তখন সেখানে থাকবে ২৪ জুলাই। তার মানে আপনাদের মধ্যে একজন এন্ট্রি নিতে পারছেন না। দোষটা আপনাদের না। দোষটা সময় এবং গন্তব্যের।’
‘তা...তা...তাহলে আমরা এখন কী করব?’ প্রশ্ন করল মুন। সে বেশি টেনশন করছে।
মুনের এ বিষয়টি আমার খুব ভালো লাগে। মুন যখন বেশি টেনশনে করে, ফাম্বল করতে শুরু করে, তখন ছোট ছোট ঘামের বিন্দু এসে তার নাকের ডগায় জড়ো হতে থাকে। সবকিছু ভুলে মুগ্ধ হয়ে আমি তখন তার দিকে তাকিয়ে থাকি। বাইপ্রডাক্ট হিসেবে দেখা যায় তার ফাম্বল করা থেমে যায়। এখনো মুন ফাম্বল করছে আর ঘামছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
‘ঢং রাখো। এখন কী করব সেটা বলো’—ধমকের সুরে বলে মুন। তার ফাম্বল করা থেমে গেছে।
আমি হাসি হাসি মুখে সাফকাত সাহেবের দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম, ‘এখন আমরা কী করব?’
‘চিন্তার কিছু নেই। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আপনারা পরের ফ্লাইটে যাবেন।’
এরপর থেকে বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা হলেই আমরা চিন্তায় পড়ে যাই, নতুন কোনো সমস্যা হবে না তো? অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিবারই একটা না একটা সমস্যা হয়, আবার সেটা কেটেও যায়। একবার তো তিনটি লাগেজই হারিয়ে গেল। সেবারও ইউরোপ ট্যুর ছিল। এটা পরে বলছি। আগে দাওয়াত আর মুনের কাহিনি বলি।

বিয়ের পরপর মুন একটি কাজ করত। খাবারদাবার রান্না করে সামনে বসে থাকত। খেতে শুরু করলে বলত, ‘ভালো হয়েছে না?’
‘হ্যাঁ’ ছাড়া উত্তরের আর কোনো অপশন নেই।
নিতান্ত অভদ্র না হলে কারও পক্ষে কি বলা সম্ভব, না ভালো হয়নি। খুবই বাজে হয়েছে।
আমি ভদ্রলোক। আমি হাসি হাসি মুখে বললাম, চমৎকার হয়েছে। আর মনে মনে ভাবলাম, বাকি জীবন খাব কীভাবে?
এখন অবশ্য মুন চমৎকার রাঁধে।

একবার বাসায় ফিরছি, রাতে তখন প্রায় ১২টা বাজে। মুন টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসে আছে। আমি খেতে বসলাম। মুন যত্ন করে তুলে দিচ্ছে, আমি খাচ্ছি।
‘আরেকটা চিকেন নাও।’ বলে জোর করে দ্বিতীয় টুকরাটা আমার প্লেটে তুলে দিল মুন। আমি খুবই খুশি হলাম, মেয়েটা এখনো আমাকে কত ভালোবাসে।
ভাবতে না ভাবতেই আরেকটি চিকেন আমার প্লেটে তুলে দিল সে। নাও না, খাও। আমি হাসি হাসিমুখে এটাও মেনে নিলাম। চতুর্থ টুকরাটা দিতে যাবে, আমি বিনয়ের সঙ্গে বাধা দিলাম। আর পারব না।
সঙ্গে সঙ্গে খেপে গেল সে, ‘নাও না। তা না হলে আবার ফ্রিজে তোলার ঝামেলা।’

মুন খাওয়াতে পছন্দ করে। খুব একটা খেতে পছন্দ করে না। তাই কোথাও বেড়াতে গেলে আমরা সাধারণত দাওয়াত খাওয়াটা এড়িয়ে চলি। এবার পারা গেল না। রেজা-ফারাহদের বাসায় দাওয়াত খাওয়া দিয়ে শুরু হলো। আর শেষ হলো সাদাত-শার্লীনদের দিয়ে। মাঝখানে আরমান, ধ্বনি, স্বর্ণালী, সৈকত, নবী, ইমরান, ইমরুল, শফিক ভাই, ভাবি—এরা তো আছেই। আর আমাদের সব সময়ের যন্ত্রণার সর্বংসহা সঙ্গী হচ্ছে সোহেল আর পিংকি।

সুইডেনের লুন্ড শহরের কেন্দ্রে চমৎকার খোলা জায়গায় শার্লীনদের বাড়ি। সামনে বিশাল খোলা প্রান্তর। একটি ছোট লেক। দূরে একটা খামারবাড়ি। সেখানে ঘোড়া চরছে। আমাদের আড্ডা যখন শেষ হলো, তখন রাত দুইটা বাজে। পুরো এলাকায় আমরাই শুধু চিৎকার–চেঁচামেচি করছি। শার্লীন বললেন, ইউরোপিয়ানরা এমনই। একটু আলাদা থাকতে পছন্দ করে। এ প্রতিযোগিতায় আরও একটু এগিয়ে থাকে সুইডিশরা। তারা চমৎকার করে বাড়িঘর সাজাবে, টেবিল লাইট জ্বালাবে, ডিম লাইট জ্বালাবে, মোমবাতি জ্বালাবে। টেবিলের ওপর এক তোড়া ফুল রাখবে। এরপর দুজন বসে চুপচাপ কফি খেতে থাকবে।
বাঙালিদের সঙ্গে এটা একেবারেই যায় না। বাঙালি হলো আড্ডাবাজ এবং দলবদ্ধ। সেই জোকটা আবারও বলি। একবার এক রেস্টুরেন্টে পাঁচ বন্ধু গিয়ে চায়ের অর্ডার করল, এক কাপ চা দেন আর চারটা খালি কাপ দেন। খাওয়ার পর কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বিল কত।
কাউন্টারে বসা ম্যানেজার বলল, বিল লাগবে না, কাপগুলো ধুয়ে দিয়ে যান।
গল্পটা শুনে শার্লীন বললেন, আমরা এখানে এটাই মিস করি শামীম ভাই।

(আমেরিকা থেকে)