এবার লাগেজ হারানোর ঘটনা বলি

noname
noname


সবকিছু বেঁধেটেধে রেডি, এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা দেব, তখনই খবর এল, ফ্লাইট দুই ঘণ্টা ডিলেইড। 
বাসায় বসে থাকতে থাকতে রিপভ্যান উইঙ্কেল অবস্থা । একসময় এয়ারপোর্টে হাজির হলাম। সেখানেও অপেক্ষা। ঢাকা এয়ারপোর্টের সবকিছু মুখস্থ হয়ে গেল। তখনই ধারণা করতে পারছিলাম এই চাপটা গিয়ে পড়বে ট্রানজিটের ওপর। কাতার এয়ারওয়েজ সাধারণত এ–জাতীয় সমস্যাগুলো চমৎকারভাবে সামলায়। আড়াই ঘণ্টার ট্রানজিটে দুই ঘণ্টা ডিলেইড—বড় ধরনের চাপ অপেক্ষা করছে বুঝতে পারছিলাম। 
ঘটলও তাই। কাতার এয়ারপোর্টে প্লেন ল্যান্ড করার সঙ্গে সঙ্গে একজন এসে বললেন, আর ইউ মিস্টার শামীম?
আমি ওপর-নিচ মাথা নেড়ে শেষ করার আগেই বললেন, ফলো মি।
এরপর উসাইন বোল্টকে পেছনে ফেলে ছুটলেন এই মাথা থেকে ওই মাথা। আমার পুরো পরিবার তখন টাইসন গে। নোরা, জারা, অরোরা, মুন আর আমি সবাই ছুটছি তার পেছন পেছন। পৃথিবীর সেরা এয়ারপোর্টের দৈর্ঘ্যে ওপর তখন আমরা প্রচণ্ড বিরক্ত।
বিশ মিনিট একটানা দৌড়ানোর পর হিন্দি সিনেমার মতো প্লেনে উঠলাম। সবাই আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সবাইকে দেখে মনে হলো আমাদেরই দোষ। একটু লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে সিটে বসে পড়লাম। প্লেন নড়তে শুরু করল।
হঠাৎ মাথায় এল বিষয়টি—আমাদের লাগেজ? আমাদেরকেই যদি এভাবে দৌড়ে এসে প্লেনে উঠতে হয়, আমাদের লাগেজের কী অবস্থা? পরক্ষণেই আবার মনে হলো, ধুর বোকার মতো ভাবছি। এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই এতটা বোকা না। 
প্লেন ল্যান্ড করল কোপেনহেগেন এয়ারপোর্টে। ডেনমার্ক। ছয় নম্বর বেল্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমরা পাঁচজন। তিনটি লাগেজ আসার পর বাকিগুলোর আর দেখা নেই। খুব চিন্তায় পড়ে গলাম। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এখন কী করি! 
ব্যাগজ ক্লেইম কাউন্টারে জানাতেই লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে গেল লোকটা। ‘উই আর ভেরি সরি’-জাতীয় কিছু কথা বলল। এরপর কম্পিউটার ঘাঁটাঘাঁটি করে জানাল, লাগেজ তিনটি দোহাতেই রয়ে গেছে। প্লেনে ওঠানো সম্ভব হয়নি। 
তাহলে এখন কী করণীয়? লাগেজ কি আর ফেরত পাব?
শুরু হলো সবার আহাজারি। আমরা যতই চিন্তিত হই, লোকটা ততই কাঁচুমাচু করে।
দেখুন, কোনো চিন্তা করবেন না। নিশ্চয়ই আপনারা লাগেজ ফেরত পাবেন। আপনারা চলে যান। লাগেজ আপনাদের ঠিকানামতো পৌঁছে যাবে। 
বলে কি এই লোক, কোনো জিনিস হারলে আবার ফেরত পাওয়া যায় নাকি? আমাদের আহাজারি আর কমে না। 
ঠিকানা দিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এক্সিটের দিকে পা বাড়াব, তখনই আমাদের দিকে একটা খাম বাড়িয়ে দিলেন সেই ভদ্রলোক। ‘এটা আপনাদের। এখানে কিছু টাকা আছে। কাতার এয়ারওয়েজ এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য খুবই দুঃখিত। তাই টাকাটা আপনাদের দিচ্ছে। উই আর ভেরি সরি।’
অবিশ্বাসী চোখে খামটা খুললাম। ভেতরে ১ হাজার ৭০০ ডেনিস ক্রোনার রাখা। বাংলাদেশের হিসাবে প্রায় বিশ হাজার টাকা।

‘কিন্তু টাকা কেন?’ মুখ ফসকে বের হয়ে গেল প্রশ্নটা। 
‘আপনাদের যদি জরুরি কিছু কিনতে হয়, তাই।’
‘বলেন কি, লাগেজ কি আর পাচ্ছি না তাহলে।’ আমাদের চোখেমুখে তখনো অবিশ্বাস।
‘না লাগেজ পাবেন না কেন? অবশ্যই পাবেন। দুই দিনের মধ্যেই পাবেন।’

মনের আনন্দে টাকা নিয়ে বের হয়ে এলাম। পাশ থেকে মুন বলল, ‘ওদেরকে বলো, চাইলে আরও কয়েক দিন লাগেজ রেখে দিক।’
দুই দিন লাগেনি, এর পরের দিনই তারা লাগেজ নিয়ে হাজির। ‘দেখুন তো সব ঠিক আছে কি না?’
ধন্যবাদ কাতার এয়ারওয়েজ। কৃতজ্ঞতা—বিনয়, ভদ্রতা আর বিশ্বাসের প্রতি।

বোনাস গল্প:
তখন আমরা উত্তর শাহজাহানপুর থাকি। আমাদের বাসার সামনের গলিতে এসে দাঁড়িয়েছি, মালিবাগ যাব। কিন্তু কোথাও কোনো রিকশা নেই। পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর দেখলাম একটা রিকশা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি হাত তোলার আগেই আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি প্রশ্ন করার আগেই আমাকে উল্টো প্রশ্ন করল, ‘স্যার কি মালিবাগ যাইবেন?’
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আমি মালিবাগ যাব এটা তুমি কীভাবে বুঝলা?’
সে উত্তর দিল, ‘স্যার, আসলে আমিও মালিবাগ যামু, কিন্তু রাস্তা চিনতেছি না।’

(আমেরিকা থেকে)