হাজাম সাহেবের দেখা

‘কি ভাইজতা, ভালো আছো?’ কথাটা শুনে আমার বুকটা কেঁপে উঠল। বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন হাজাম (যাঁরা খতনা করেন)। তাঁর কাঁধে আঁটোসাঁটো একটি ঝোলা ব্যাগ। ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল। সে চুলে তেল দেওয়া। কালো কুচকুচে গায়ের রং। ঝোলার ভেতরে নুনু কাটার সরঞ্জাম। তাগড়া চেহারা। লোকটাকে আমি কয়েক বছর ধরে চিনি। এবাড়ি-ওবাড়ি মুসলমানি করাতে আসেন। আমরা দৌড়ে দেখতেও গেছি সে দৃশ্য। যার মুসলমানি হাবে, তার কী আতঙ্ক! কান্নাকাটি, চিৎকার, চেঁচামেচি।

আমার সেসব কথা মনে পড়ল। হাজাম সাহেব বললেন, ‘এইবার না আগামীবার। তোমার মায়ে কইয়া দিছে।’
তার মানে ফাইনাল? আগামী বছর আমার মুসলমানি হবে! আতঙ্ক শুরু হয়ে গেল আমার। অনেকে সান্ত্বনা দিল। ‘আরে কোনো ব্যাপার না। তুই কোনো টেরও পাবি না। খালি মনে হইব—মনে হইব যে, একটা লাল পিঁপড়া তোর নুনুতে কামড় দিল।’

কিন্তু ভয় কি আমার কাটে! যতই দিন ঘনিয়ে আসে, ততই আতঙ্ক বাড়তে থাকে। আশপাশের বাড়ির বড় বড় মেয়েরা আমাকে দেখলে মিটিমিটি হাসে। তার মানে তারাও আমার বিষয়টা জেনে গেছে। কী লজ্জা! এই মেয়েদের দেখলেই আমি পালানোর চেষ্টা করতাম।

অবশেষে ঘনিয়ে এল সেই সময়। আমাকে গোসল করানো হলো। পরানো হলো একটা লুঙ্গি। হাজাম বেশ আগেই এসে উপস্থিত। তিনি তাঁর ঝোলা থেকে বের করতে লাগলেন যন্ত্রপাতি, যেগুলো দিয়ে কাটাকাটি হবে। দূর থেকে দেখে আমার ভয় দ্রুত বাড়তে লাগল। আমাকে কেউ একজন জোর করে টেনে নিয়ে গেলেন হাজামের কাছে। চকচকে দন্ত বিকশিত করে হাসলেন তিনি। কী আনন্দ তার। তিনি কাটবেন। নগদ টাকা পাবেন। আর আমার ভয়ে প্রাণ বের হয়ে যাচ্ছে।

একটা কাঠের পিঁড়িতে বসানো হলো। পেছন দিক থেকে একজন আমার হাঁটুর ফাঁকে দুই হাত ঢুকিয়ে দুই পা চেপে ধরলেন। যেন আমি ছটফট করতে না পারি। চাচার বাড়ির লোকজন। আমাদের বাড়ির লোকজন। আশপাশের লোকজন কেউ কেউ দৌড়ে ছুটে এল মুসলমানি দেখতে।

হাজাম ‘জিনিসটা’ ধরলেন। আমার সারা শরীরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। পেছনে থেকে কেউ একজন আমার দুটো চোখ তার দুই হাতে চেপে ধরলেন। আমি বুঝতে পারছি কী হচ্ছে ঘটনা। বাঁশের চটি জাতীয় একটি চেংগি গিয়ে সামনের চামড়া টেনে ধরলেন। অতঃপর ক্যাচ করে কেটে ফেললেন। যন্ত্রণায় আমার সে কী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। হাজাম বললেন, ‘আরে বাবা কানবি যদি আ আ করে কান। কুঁতিস না। মন খুইলা কান্নাকাটি কর। কুঁতিস না।’

আমাকে কোলে করে নিয়ে যাওয়া হলো পুবের ঘরে। বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হলো চিৎ করে। নৌকার মাস্তুলের মতো হয়ে রইল শিশ্ন। হঠাৎ বাইরে কোলাহল, হাসাহাসি। ‘অ্যাই, খাইয়া ফালাইলো। মুরগিডায় খাইয়া ফালাইলো। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনতে পেলাম। কেউ একজন বলছে, ‘ওর সুনার মাথা তো মুরগিতে খাইয়া ফালাইল।’

কোনো কোনো বছর এমন হতো, মাঠঘাট চৌচির হয়ে যেত। বৃষ্টির দেখাই মিলত না। তখন গ্রামে হতো ‘মেঘ নামানি গান’। একদল মেয়ে মাটির রান্নার পাতিলের কালি সারা মুখে মেখে নিত। তাদের একসঙ্গে দেখলে আকাশের মেঘের মতোই মনে হতো। এমন ধারণা দিছে, মুখে কালি মেখে গান গাইলে আকাশে মেঘ সাজবে এবং ঝমঝম করে বৃষ্টি নামবে চারদিকে। শস্য ফলানোর মাটি ভিজবে। কৃষক লাঙল নিয়ে মাঠে চাষ করতে পারবেন। ফসলের বীজ বুনতে পারবেন। তাদের গানের মধ্যে মেঘবৃষ্টির জন্য আকুল আবেদন থাকত।

গানের একটি লাইন এ মুহূর্তে মনে পড়ছে—
‘হরিচান্দের গোপাল রে
ধীরে ধীরে মেঘ সাইজা দে।’
গোপালের কাছে প্রার্থনা। আকাশ ভরে মেঘ সেজে দাও। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামুক।
যারা এই গান গাওয়ায় অংশ নিত তারা ছিল সবাই কৃষক-চাষিদের সন্তান।
বাড়িতে বাড়িতে গান গাওয়া হলে তারা চাল-ডাল চেয়ে নিয়ে যেত। পুরো গ্রামে সাত দিন গান গাওয়া শেষে সেই চাল-ডাল দিয়ে শিরনি খাওয়ার আয়োজন করত। সেই আয়োজনে যে-কেউ অংশ নিতে পারত।

‘গাসছি’ নামে একটি পার্বণ হতো বাড়িতে বাড়িতে। আমরাও আমাদের বাড়িতে সেটি করতাম। বাড়ির উঠানে একটি ছোট জায়গায় লেপামোছা হতো। সেখানে রাখা হতো ধান-দুর্বা। একটি পিতলের লোটায় পানি ভরে সেটাতে রাখা হতো বেশ কয়েকটি আমপাতা। আর রাখা হতো একটি কুড়াল। হলুদ বাটা।

ভোরবেলা আমরা ঘুম থেকে উঠে যেতাম। তারপর একজন সেই কুড়াল নিয়ে ছুটে যেত বাড়ির প্রতিটি ফল গাছের কাছে। সে হয়তো কোপ দিল আম গাছের গোড়ায়। আর সঙ্গে সঙ্গে বলত, ‘আইজকা তরে কাইট্টাই ফালামু। ও ভালোমতো ফল দেয় না।’

পাশাপাশি আরেকজন তার বলা শেষ হলে বলত, ‘না-না, ভাই ওরে কাটিস না। সামনের বছর ও অনেক ফল দিবো।’

সে আমগাছে কোপ দেওয়া বন্ধ করত। তারপর এগিয়ে যেত আরেক গাছের কাছে। হয়তো একটি কোপ বসাল জাম গাছের গোড়ায়। আবার সেই একই উচ্চারণ, ‘ওরে রাখুম না, কাইটাই ফালামু....।’
আরেকজনের বাধা, ‘নারে ভাই কাটিস না, সামনের বছর গাবলা গাবলা (বড় বড়) জাম দিব।’

ওপরের এই আয়োজনটি হতো প্রতিবছর। সকালবেলা আমরা শরীরে হলুদ মেখে গোসল করতাম নদীতে বা পুকুরে নেমে। এভাবে গোসল করলে নাকি ত্বক ভালো থাকে।

আমাদের জমিজমা ছিল বেশ। দূরের খেত থেকে কৃষকেরা ধান কেটে আনত। পাট কেটে আনত। ধান কাটার পর সেগুলো উঠানে মলন (মাড়াই) দেওয়া হতো। ধানের গোছার ওপর দিয়ে মুখে টুলি বাঁধা গরুগুলোকে চারদিকে ঘোরানো হতো। মলন শেষ হলে উঠানের ধান থেকে ধানের খ্যার (খড়) আলাদা করা হতো।

পাট কেটে এনে পানিতে জাগ (পানিতে চুবিয়ে রাখা) দেওয়া হতো। তারপর কিছুদিন পর সেগুলো থেকে আঁশ ছাড়ানো হতো। উঠানজুড়ে শুকাতে দেওয়া হতো পাট। আঁশ ছাড়ানোর পর যেটা বের হতো তাকে বলা হতো পাটখড়ি বা সমলি।

সমলি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সমলির টুকরা আগুনে দিয়ে সিগারেটের মতো টান দিতাম। কতজনের যে এভাবে বিড়ি-সিগারেট খাওয়ার হাতেখড়ি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আমিও সমলিতে আগুন ধরিয়ে সিগারেটের মতো টানতাম।

আমার হাতে থাকত একটা গুলতি। গ্রামে সেটাকে বলতাম কেটি। কেটি বাজারেও কিনতে পাওয়া যেত। নিজেরাও বানিয়ে নিতাম। কেটি চালাতে লাগত গুলি। আমি আর আমার চাচাতো ভাই এঁটেল মাটির সন্ধানে বের হতাম। এঁটেল মাটি সংগ্রহ করে সেটাকে ভালোমতো দুই হাতে ছেনে নিতাম প্রথমে। তারপর পরিমাণমতো মাটি হাতের তালুতে নিয়ে গোল করতাম। মাটিগুলো গোল মার্বেলের মতো হয়ে যেত। সেটি খুব গোপনে কোনো খেতের মাঝে শুকাতে দিতাম। সেগুলো চুরি হওয়ারও ভয় থাকত। সেটা শুকানোর বিকল্প ব্যবস্থাও ছিল। যে চুলায় রান্না হতো, রান্না শেষ হলে সেগুলো চুলায় দিয়ে রাখতাম। অল্প সময়েই গুলি কটকটে হয়ে যেত।

অতঃপর আমি আর সুইট শিকারে বের হতাম। বড় সড়ক পার হলেই ছিল কানদুনি কাপালির বাড়ি। সেই বাড়িতে ছিল নানা ধরনের পাখির আস্তানা। গোধূলিবেলায় পাখিগুলো আসতে শুরু করত সেই বাড়িতে। সারা দিন বিল-বাঁওড়ে পাখিরা থাকত খাবারের সন্ধানে। আর সন্ধ্যায় আসত পরিচিত আশ্রয়ে। সেই বাড়ির বড় একটি বাঁশঝাড় সাদা বকে ধবধবে হয়ে উঠত। আমি এলোমেলোভাবে কেটি দিয়ে গুলি ছুড়তাম। আর বকগুলো আতঙ্কে কককক করে দল ধরে উড়ে যেত আকাশে।

আমার প্রথম শিকার ছিল একটি কানি বক। রুম মামাদের পুকুরে মাছ শিকারের সন্ধানে ছিল বকটা। আমি গুলি চালাতেই পাখিটা ছটফট করে উঠল। দৌড়ে গেলাম সেখানে। লম্বা গলা উঁচু করে ঠোকর দিতে চাইল। কিন্তু কৌশলে ধরে ফেললাম। একটা কচুরিপানা ছিঁড়ে ওর ঠোঁটে ঢুকিয়ে দিলাম, যেন আমাকে আর আক্রমণ করতে না পারে। দুই পা ধরে ঝুলাতে ঝুলাতে নিয়ে গেলাম বাড়িতে।
কী বীরত্ব আমার!
আমাদের বড় ঘরের পেছনে বাঁশঝাড়। দেখি, সেখানে একটি টুনটুনি নাচানাচি করছে। এক গুলিতেই ধুম করে পড়ে গেল মাটিতে। পরে আবিষ্কার করলাম, গাছের দুটি পাতার ভাঁজে সেটির বাসা।
কী নিষ্ঠুরতা ছিল আমার!
সুইটদের ছিল বড় একটি পেয়ারাগাছ। প্রায় একটি বড় আমগাছের সমান। এত বড় পেয়ারাগাছ আমি কখনো দেখিনি। একদিন সকালবেলা দেখি একটি দোয়েল পাখি। ইচ্ছামতো লেজ ওঠানামা করছে। কেটি চালাতেই ওর বুকে গুলি লেগে গেল। গাছের ডাল থেকে ঘুরতে ঘুরতে পড়ে গেল মাটিতে। খুব একটা নড়াচড়া করছে না। প্রথমবারে কোনো আহত পাখির প্রতি মায়া লাগল আমার। পাখিটি কি মারা যাবে! দোয়েলটাকে আলতো করে ধরে দৌড়াতে থাকলাম আমাদের পুকুরের দিকে। পুকুরঘাটে গিয়ে হাতের মুঠোয় পানি তুলে ওর মাথায় দিতে লাগলাম। কিন্তু পাখিটা আস্তে আস্তে আমার হাতে ঢলে পড়ল। বুঝলাম পাখিটা মারা গেছে।

খুব কষ্ট হলো আমার। খুব কষ্ট। যে আমি পাখি মরার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়াতাম, সেই আমারই এত কষ্ট হচ্ছে শিকার করে।

অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। রাস্তায় খুঁজে পেলাম একটা বাঁশের কঞ্চি। কঞ্চি দিয়ে সেই পেয়ারা গাছটার নিচে গর্ত করলাম। তারপর আলতো করে শুইয়ে দিলাম ওকে।
আর কেটিটা ছুড়ে ফেলে দিলাম একটি বেতের ঝোপে!