আর কোনো যুদ্ধ নয়

যাদুঘরের আভন্তরিনভাগ
যাদুঘরের আভন্তরিনভাগ


প্রতিটি জাদুঘর যেন ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। যে প্রলয়ংকরী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর ওয়েস্টার প্ল্যাটিতে (Westerplatte Peninsula) শুরু হয়েছিল, জার্মানির আক্রমণে উপদ্বীপের পোলিশ সামরিক বেসটি কেঁপে উঠেছিল, পোল্যান্ডের জাদুঘরটি সেই যুদ্ধের জ্বলন্ত সাক্ষী।
পটভূমি ও ধারণা

ইতিহাসের পাতা থেকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য ড্যানিয়েল লিবিসকিন (Daniel Liebeskind) জুরির নেতৃত্বে বিচারক প্যানেল নির্বাচিত করা হয়। গডিনিয়ার (Gdynia) কোয়াদ্রাত স্থাপত্যের স্টুডিওটি (Kwadrat architectural studio) নির্বাচিত হয়। জাদুঘরটি প্রায় ২৫ একর জায়গাজুড়ে। আর এর ভবনটি ২৬০০০ বর্গমিটারজুড়ে। বিল্ডিংটি তিনটি অংশে বিভক্ত, যা অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সংযোগকে প্রতিফলিত করে। অতীত—ভূগর্ভস্থ, বর্তমান—বিল্ডিংয়ের চারপাশে বর্গক্ষেত্র আর ভবিষ্যৎ—ক্রমবর্ধমান বাঁকানো টাওয়ার যার ছাদ ৪০.৫ মিটার পর্যন্ত পৌঁছেছে। স্থাপত্যের আকৃতিগত ধারণাটি এই অনুমান করে করা যে যুদ্ধের বিধ্বংসী রূপ মাটির নিচে লুকানো রয়েছে এবং আশার আলো প্রধান প্রদর্শনীর মধ্যে বিচ্ছুরিত। শক্তিশালী আবেগ এবং উদ্দীপিত এই আশার আলো যেন বাইরের বিশ্বের সঙ্গে বিল্ডিংয়ের অভ্যন্তরীণ লিঙ্ক। এলাকার পুরো ব্যবস্থাটি ভবনটির চারপাশে বর্গক্ষেত্রের পরিপূরক, যেখানে আপনি খোলা বাতাসে ইতিহাসের ঘটনা অবলোকন করতে পারবেন। আপনার দৃষ্টি যেদিকেই যাবে, দেখবেন প্রতীকী পোলিশ পোস্ট অফিস বিল্ডিং, রাডুনিয়া খাল, শিপইয়ার্ড ক্রেনস এবং গির্জা টাওয়ার—সবই যেন পোল্যান্ডের বৃহত্তম ঐতিহাসিক জাদুঘরটির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

মোতলাওয়া নদীর মুখোমুখি এই জাদুঘরটি গডানস্ক (Gda sk) শহর থেকে দান করা হয়। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে ৭০-৮০ মিলিয়ন মানুষের হৃদয়বিদারক কাহিনি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সারা বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। উন্মুক্ত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দিরেক্তর Paweł Machcewicz ও অনেক কর্মী বরখাস্ত হন এবং অনেক প্রদর্শনীর আমূল পরিবর্তন করা হয় যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্বজনীন চিত্র তুলে ধরার অন্তরায়। ইতিমধ্যে জাদুঘরটি পোলিশ সরকারের জাতীয়তাবাদী প্রভাব নিয়ে তুমুল বিতর্কিত হয়েছে। ইতিহাসবিদেরা জাদুঘরটিকে শুধু পোল্যান্ডের দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন। এসব বিতর্ক সত্ত্বেও ইতিহাসকে নতুন করে জানার আকাঙ্ক্ষায় পাড়ি জমায় আমাদের ভ্রমণপিপাসু মন। আর দেরি না করে চলুন জাদুঘরটি ঘুরে আসা যাক।

কীভাবে সেখানে পৌঁছাবেন?
গডানস্কের পুরোনো শহর বা তার কাছাকাছি থেকে হেঁটেই আপনি পৌঁছাতে পারবেন। ক্রেন থেকে মাত্র ১০ মিনিটের পথ। প্রবেশ সংখ্যা সীমিত। তাই অনলাইনে আগাম টিকিট বুক করে রাখতে পারেন। মাত্র ৫ জিলোটি (পোল্যান্ডের মুদ্রা) খরচ করলে আপনি মাল্টি-ভাষাগত অডিও গাইড পাবেন। চমৎকার এই গাইডটি আপনাকে ভবনের কোথায় যেতে হবে তা জানিয়ে দেবে। এ ছাড়া আপনি নিজস্ব গাইড ভাড়া করতে পারেন।
প্রদর্শনী
মোট ২000–এরও বেশি প্রদর্শনী ছড়িয়ে আছে পুরো জাদুঘরটিতে। ‘দ্য রোড টু ওয়ার’, ‘দ্য হর্স অব ওয়ার’ এবং ‘দ্য ওয়ার’স লং শ্যাডো’ এই তিনটা বিভাগে প্রদর্শনীগুলো ভাগ করা। সবগুলোই মোট ১৮টি থিমে সাজান।
প্রবেশ করতেই আপনি পাবেন পোলিশ শিশু শিক্ষা প্রোগ্রামের একটি প্রদর্শনী। এটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা। সেখানে দেখতে পাবেন একটি পোলিশ শ্রেণিকক্ষ, যেখানে চলচ্চিত্র দেখানো হচ্ছে। চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে আপনি পৌঁছে যাবেন প্রাক-যুদ্ধ ওয়ারশ (Warsaw) অ্যাপার্টমেন্টের লিভিং রুমে। তৎকালীন সময়ে বসবাসকারী পরিবারের বিভিন্ন ধরনের খাবারের উদাহরণ, প্রাক-যুদ্ধের ফার্নিচার এমনকি ওই সময়ের শিশুদের খেলনার উদাহরণও সেখানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। পরবর্তী কক্ষে প্রবেশ করলে আপনি দেখতে পাবেন যে এটি ঠিক একই রুম, কিন্তু এখন বাইরের রাস্তায় জার্মান সৈনিক দাঁড়িয়ে। ওয়ারশ তাদের দখলে। পরের কক্ষগুলোতে যেতে যেতে আপনার সামনে একটি কাহিনি ফুটে উঠবে। সাধারণ একটি ওয়ারশ পরিবারের কাহিনি। যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই পরিবারের সঙ্গে যা যা ঘটেছে। দুর্ভাগ্যবশত, এই অংশে কোনো ইংরেজি অডিও বা সাইন ছিল না, তবে তাতে কাহিনির মূল বক্তব্য উপস্থাপন করতে এতটুকুও কমতি হয়নি।
এই অংশের পরেই আপনি সোজা, বিস্তৃত করিডরে এসে পৌঁছাবেন। প্রদর্শনীর মূল অংশ এটি। আপনি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে, শহরটি ধ্বংস হওয়ার আগে ঠিক এখানেই দাঁড়িয়েছিল কালের সাক্ষী গ্রেট স্ট্রিট। জাদুঘরের নির্মাণ শুরু হওয়ার আগে প্রত্নতাত্ত্বিক কাজ সম্পন্ন করার সময় সেই গ্রেট স্ট্রিটের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করা হয়েছিল।

আপনি যুদ্ধের আগের পোল্যান্ডকে দেখতে পাবেন; আক্রমণাত্মক জার্মানি আর প্রতিশোধমূলক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে পিষ্ট অবস্থায়। পোল্যান্ডই প্রথম দেশ যা হিটলারের একনায়কতন্ত্রের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিল। এই প্রত্যাখ্যান থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। যে আগুন গডানস্ক শহর আর পোল্যান্ডের সীমানা অতিক্রম করে পর্যায়ক্রমে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পুরো বিশ্বের ভাগ্যকে সিল করে দেওয়া নথিটির একটি অনুলিপি—মলোটভ চুক্তি। করিডরের দেয়ালের ওপর এখন ঝুলছে।
প্রদর্শনী নিজেই যেন যুদ্ধের গল্প বলতে বলতে আমাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। ৮ম রুমে ইউনিফর্ম, অস্ত্র ও সরঞ্জামের পাশাপাশি ইন্টারেক্টিভ স্ক্রিন রয়েছে। এনিগমার (Enigma) কোড ভাঙার গল্পও পাবেন। প্রদর্শনীর চূড়ান্ত অংশ পরের দিকে পাবেন। ইউরোপ তখন বিভক্ত। জার্মানিও। অবশেষে বার্লিন। পোল্যান্ডের প্রতিরক্ষায় ইউকে এবং ফ্রান্সও বিধ্বস্ত ও পরিত্যক্ত। চলচ্চিত্র, ছবি, চমৎকার ইংরেজি অনুবাদ, আর্টিফ্যাক্টস, যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত পরিবারের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলো আপনাকে আমূল নাড়া দেবে।
প্রদর্শনীর দ্বিতীয় অংশের শুরুতে পাবেন স্মরণীয় কিছু। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে, আমেরিকান সাংবাদিক জুলিয়ান ব্রায়ান ওয়ারশে অবস্থান করছিলেন। জার্মানি তখনই হামলা চালায়। তিনি আমেরিকান সংবাদ এবং তার প্রতিবেদনের জন্য চাক্ষুষ সেই হামলা রেকর্ড করেছিলেন। সেই রেকর্ডের মধ্যে আছে একটি ছোট্ট মেয়ের ছবি। মেয়েটি তার বোনের রক্তাক্ত দেহের পাশে হাঁটু গেড়ে বসা। বোনটি মৃত কিন্তু ছবির মুহূর্তটি আজও জীবন্ত।

ছবিটা দেখে প্রশ্ন জাগে, এই জাদুঘরটি কি শুধু রেফারেন্সের জন্য? নাকি যারা মারা গেছে তাদের পরিসংখ্যান জানার জন্য? না তার থেকে অনেক বেশি কিছু? এটি শুধু জাদুঘর নয়, এটি মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের প্রতীক, তাদের বীরত্বের উৎস। যা প্রত্যেক দর্শনার্থীর মানসপটে গভীর প্রভাব ফেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুধু যুদ্ধ আর যোদ্ধাদের গল্প নয়। এটি জোরপূর্বক শ্রম, নির্যাতন, হত্যা এবং মানুষের আত্মার ধ্বংসের শ্লোকগাথা। এ জন্যই হয়তো ওয়েস্টারপ্ল্যাটের প্রথম হামলার জায়গাটিতে বিশাল সাদা অক্ষরে লেখা - Nigdy więcej wojny (আর কোনো যুদ্ধ নয়)
তথ্য উৎস: ইন্টারনেট ও ব্যক্তিগত ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা

মাস্টারস ইন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অ্যান্ড মার্কেটিং
নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি