আমি হাঁটলে চাঁদও হাটে

ঈদ উপলক্ষে আমাদের গ্রামে হতো নাটক। আমাদের বাড়ির সামনের ছোট মাঠে সেই নাটক হতো। নাটকের রিহার্সেল চলত অনেক দিন ধরে। গ্রামে চলতো সেই নাটক নিয়ে আলোচনা। কে কোন চরিত্র পেল এটা ছিল আলোচনার বিষয়। যে নায়কের চরিত্র পেত, সে হয়ে উঠত গ্রামের হিরো। গ্রামের বাদশা ভাই চাকরের পাট করতেন খুব ভালো। চাকর-বাকরের দুঃখ তিনি খুব নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতেন। কারও কারও মনঃক্ষুণ্ন হতো কাঙ্ক্ষিত চরিত্র পেত না বলে।

রিহার্সেল করতে করতে সেই দিন ঘনিয়ে আসত। আমাদের বাড়ি থেকে মাঠে নিয়ে যাওয়া হতো ঘরের চৌকি। অন্যদের বাড়ি থেকেও আনা হতো। মাঠের মধ্যে সেগুলো পেতে বানানো হতো মঞ্চ।
আশপাশের কয়েক গ্রামের লোকজনও ছুটে আসত নাটক দেখতে। সন্ধ্যার পর শুরু হতো সেই নাটক। হ্যাজাক লাইট জ্বালানো হতো কয়েকটা। আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠত আমাদের বাড়ির সামনের মাঠ।
মঞ্চের সামনের অংশ দর্শক সারিতে বিছানো হতো নাড়া (খড়)। সেই নাড়াতে লোকজন বসে পড়ত অনেক আগ্রহ নিয়ে।

একবার সিদ্ধান্ত হলো গ্রামেরই কেউ নাটক লিখবেন। শেষ পর্যন্ত রফিক উদ্দিন বিশ্বাস লিখে ফেললেন নাটক। নাটকটি বেশ জমে উঠেছিল।
নাটক শেষ হওয়ার পরও তার রেশ থেকে যেত বেশ কয়েক দিন। কে কেমন অভিনয় করল সেসব নিয়ে হতো আলোচনা।

একই মাঠে বেশ কয়েকবার হয়েছিল ‘কবিগান’। দূর থেকে আসত সেই কবিগানের লোকজন। ছন্দে ছন্দে কথা বলে দুপক্ষের সে কি লড়াই। একবার দেখতে বসলে শেষ না করে ওঠা যেত না। অনেক দূর থেকে লোকজন চলে আসত গ্রামে। গমগম করে উঠত গ্রাম। বসে বসে কবির লড়াই উপভোগ করতেন তাঁরা।

একবার আমি তাসুল্যা নামে একটি গ্রামে গিয়েছিলাম ‘কৃষ্ণলীলা’ দেখতে। মঞ্চের চতুর্দিকে ঘিরে বসেছে নারী-পুরুষ। আমার বয়সী ছেলেদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। আমি দীর্ঘক্ষণ বসে বসে ‘কৃষ্ণলীলা’ শুনলাম।
প্রাইমারি স্কুলে আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শিমন ডি রোজারিও। তিনি এলাকায় শিমন মাস্টার নামেই পরিচিত ছিলেন। বাড়িতে একটা মুদি দোকানও চালাতেন। আমরা তাঁর বাড়ি থেকে কিনতাম ‘লাল ফোঁটা’ ও ‘চারা’ বিস্কুট। আমাদের এলাকায় ‘লরেন্স বেকারির’ এই বিস্কুট খুবই বিখ্যাত। লরেন্স বেকারির দোকান বান্দুরা বাজারে। মালিক তুইতাল গ্রামের। প্রায় তিন পুরুষ ধরে তাঁদের বিস্কিটের কোয়ালিটিটা ধরে রেখেছেন।

ছোটবেলায় এই বিস্কিট ছিল অমৃতের মতো। এখনো গ্রামে গেলে লাল ফোঁটা ও চারা বিস্কিট কিনে নিয়ে আসি ঢাকায়। বিস্কিটে কামড় দিলেই শৈশবে ফিরে যাওয়া যায়!
স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে কয়েক দিন পড়েছিলাম আলাউদ্দিন মাস্টারের কাছে। গ্রামে তিনি পরিচিত ছিলেন আলেফ মাস্টার হিসেবে। মনে পড়ে, তিনি একদিন আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সুজাপুর প্রাইমারি স্কুলে। ওই স্কুলে একদিনই গিয়েছিলাম। মায়ের বাবার বাড়ি সুজাপুর গ্রামে। মাও সেই স্কুলে কিছুদিন পড়েছিলেন।

তার কিছুদিন পর ভর্তি হলাম কউনিয়াকান্দি প্রাইমারি স্কুলে। স্কুল মানে চারদিকে খোলা একটি ঘর। ছাত্রছাত্রী দশ–বারো জন। সঙ্গে বই নিয়ে যেতাম কিনা মনে নাই। তবে আমার একটি স্লেট ছিল। স্কুলঘরে ছিল ছোট ছোট গর্ত। যেগুলোতে আমরা পানি জমাতাম। তারপর সেই পানি দিয়ে স্লেট মুছতাম। স্কুলে একমাস পড়েছিলাম হয়তো।

সেই সময় আকাশের চাঁদের সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিল। একদিন পূর্ণিমা রাত। আমরা উঠানে খেলা করছি। খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে বড়রা জ্যোৎস্নায় আড্ডা দিচ্ছে। আমাকে কে একজন বলল, ‘আকাশের চাঁদটা দেখ। আমি হাঁটলে চাঁদটাও আমার সঙ্গে চলতে থাকে। দেখবি?’
‘দেখব।’

সে হাঁটতে থাকল, আর কি আশ্চর্য—চাঁদটাও তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে থাকল। বিস্মিত হলাম আমি। পরের দিনের ঘটনা। আকাশে চাঁদ আছে। আমি চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলাম। বাপরে, দেখি চাঁদটাও আমার সঙ্গে সঙ্গে চলছে। তারপর থেকে কতদিন কতবার চাঁদের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরেছি সন্ধ্যারাতে। বড়বেলায় সেই চাঁদবন্ধুর কথা মনে করে একটি অণুকাব্যও লিখেছি—

আমি হাঁটলে চাঁদও হাটেন
আমি থামলে চাঁদও থামেন
এতই যদি ভালোবাসেন
তবে আকাশ থেকে নামেন।

মাঝেমধ্যে সুজাপুর থেকে রতন দাদু (মামাতো ভাই) আসতেন আমাদের বাড়িতে। তাঁর হাতে থাকত একটা পাখি ধরার ফাঁদ। ফাঁদটা বাঁকা চাঁদের মতো ছিল দেখতে। ফাঁদের দুদিকে সুতা বাঁধা থাকত। সুতায় মাখানো হতো এক ধরনের আঠা। কি একটা গাছ থেকে গোটা গোটা ফল নিয়ে আসতেন দাদু। সেগুলো মুখে দিয়ে চিবানো হতো। চিবালেই সেটা আঠা হয়ে যেত। আঠা মাখানো হতো ফাঁদের সুতায়।

ফাঁদের মাঝখানে রাখা হতো এক ধরনের পোকা। আঞ্জুম ভাই আর দাদু যেতেন ফাঁদ নিয়ে। বিশেষ করে মাছরাঙা পাখি দেখলেই সেখানে ফাঁদ পেতে তাঁরা দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কোনো কোনো সময় মাছরাঙা পাখি উড়ে এসে পোকাটা ধরতে গেলেই তার দুই পাখা আঠায় আটকে যেত। আর তখন দুজন দৌড়ে গিয়ে পাখিটাকে ধরতেন।

কখনো কখনো বেদেরা আসত গ্রামে। একটি অভিনব উপায়ে তারা পাখি শিকার করত। একদিন নদীর পারে গিয়েছি একটি দেবদারু বনে। দেখলাম একটি লোক ওপরের দিকে তাকিয়ে কোনো কিছু দেখছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘খচমচ কইরো না। পাখি মারুম পায়ের নিচে ছিল শুকনা পাতা।’

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। তার হাতে অনেকগুলো নল। বড়শির লম্বা ছিপের মতন। তিনি ওপরের দিকে তাকিয়ে একটি নলের পেছনে আরেকটা নল লাগালেন। একের পর এক নল লাগাতেই থাকলেন। সেটা হয়ে গেল বিশাল লম্বা। পৌঁছে গেল গাছের উঁচুতে, মগডালে। সেখানে বসেছিল একটি রাজঘুঘু। দুপুরে ডালে বসে ঘু ঘু করছিল। হঠাৎ তার ডাক থামিয়ে দিলেন লোকটা। পাখিটার বুকে গিয়ে লাগল নলটা। যার মাথায় লাগানো ছিল ধারাল তীর। নল টেনে টেনে লোকটা তাঁর হাতের কাছে নিয়ে এলেন পাখিটা। পাখিটা তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

ঋষিরা আসত আমাদের গ্রামে। তাদের হাতে থাকত এক ধরনের টেঁটা, হাজামজা পুকুরের কিনারে কিনারে টেঁটা দিয়ে খোঁচাতে থাকত। যদি পানির নিচে ঠনঠন করে শব্দ হতো, তাহলে তারা বুঝত সেটা কচ্ছপ। তারপর সেটা হাত দিয়ে তুলত ওপরে। তাদের মাংস খাওয়ার প্রধান উৎস ছিল কচ্ছপ।

তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। তুইতাল স্কুলে। স্কুলে গিয়ে দেখি আমাদের ক্লাস টিচার নেই। তাঁর বদলে তাঁর ছেলে এসেছেন। তিনিই আমাদের পড়াবেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম তিনি মাইকেল স্যারের ছেলে ইশিদোর। তিনি আমাদের পড়াচ্ছিলেন। কী একটা প্রশ্নও করেছিলেন। আমি পারিনি। হঠাৎ তিনি খেপে গিয়ে বললেন, ‘তুমি জীবনেও স্কুল পাস করতে পারবে না।’ কথাটা শুনে আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। ইশিদোর স্যারের প্রতি মনে মনে বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে ছিলাম।

স্কুলের শিক্ষিকা ম্যাডামকে আমরা বলতাম দিদি। শিক্ষিকাদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিলেন খ্রিষ্টান। স্টেলা নামের এক শিক্ষিকা ক্লাসে নানা ধরনের গল্প করতেন। একদিন তিনি তাঁর ব্যাগ থেকে এক শ টাকার একটি নোট বের করলেন। সেটা হাতের মুঠোয় নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ‘তোমরা কে কে এক শ টাকার নোট দেখেছ?’
আমরা কেউ হাত তুলতে পারলাম না। তারপর তিনি প্রত্যেকের বেঞ্চের সামনে গিয়ে গিয়ে টাকাটা দেখালেন।

আমাদের ক্লাসে অনেক বয়স্ক মেয়েও পড়ত। কেউ কেউ পড়াশোনায় মোটেও ভালো ছিল না। তারা পড়া না পারলে আমাদের দিয়ে শিক্ষকেরা তাদের কান মলাতেন। আমরা সাইজে ছোটরা বসার বেঞ্চিতে দাঁড়িয়ে তাদের কান মলতাম। আপাদের সমান বয়সী মেয়েদের কান মলে দিতাম। তারা লজ্জায় লাল হয়ে যেত।

মাইকেল স্যার (মাইকেল গোমেজ) আমাদের বাংলা পড়াতেন। পড়া না পারলে ভয়াবহ শাস্তি দিতেন। কানের লতিতে পেনসিলের আগা চেপে ধরতেন। আবার পড়া পারলে আদরও করতেন খুব।
একদিন স্কুলে না গেলেই কৈফিয়ত দিতে হতো—
‘এই কাল স্কুলে আসো নাই ক্যান?’
আমরা প্রায় সবাই একই উত্তর দিতাম। ‘স্যার দাস্ত অইছিল।’

প্রথম প্রথম ‘দাস্ত’ অর্থ কি জানতাম না। অন্যরা কৈফিয়তে বলত দাস্ত হয়েছে, আমিও তাই বলতাম। পরে জেনেছি দাস্ত মানে ‘পাতলা পায়খানা’। শব্দটি কোত্থেকে আমদানি হয়েছিল জানা নেই।

পড়া না পারলে বড় শাস্তি হিসেবে ‘ডিটেনশনে’ থাকতে হতো। ছুটির ঘণ্টা ঢং ঢং করে বাজলে সবাই চলে যেত। আর কয়েকজন থাকত স্কুলের বারান্দায়। যারা শাস্তি পেয়েছে। নির্দিষ্ট পড়া মুখস্থ করে বাড়ি যেতে হতো। আমিও মাঝেমধ্যে পড়ে যেতাম সেই দলে। ক্লাস টুর ক্লাস হতো গির্জাঘরের বর্ধিত একটা অংশে। আমি তো টুতে ভর্তি হয়েছিলাম। ভর্তি হওয়ার কয়েক দিন পরে ঢুকে গেলাম গির্জার ভেতরে। মা মেরির মূর্তি ও যিশুখ্রিষ্টের মূর্তি দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। ফাঁক পেলেই আমি সেই মূর্তির দিকে চলে যেতাম। আমাদের যিনি পড়াতেন, তাকে বলতাম বৌদিদি। কেন বৌদিদি বলতাম, সে প্রশ্ন তখন মনে জাগেনি। এখন কেন জাগছে!