বকচরে মোটরসাইকেলের প্রবেশ

আলীর বাবার চিৎকারে অনেক সময় আমাদের ঘুম ভাঙত—
‘আরে দুরু ডাইনে
আরে আরে বাঁয়ে’

লাঙল নিয়ে তিনি খেতে নেমেছেন চাষ করতে। তার নিজস্ব কোনো জমি ছিল না। হালের গরুর অবস্থাও ছিল কাহিল। অনেক জমি চাষের ক্ষমতা ছিল না তার। তিনি আর তার স্ত্রী ধান ভানতেন। বাড়িতে ছিল ঢেঁকি। অন্যরা তাদের কাছে ধান ভানতে দিতেন। এক মণ ধান ভানতে পারলে তারা পেতেন দুই সের চাল।

আমাদের বাড়ি থেকে আলীর বাবা কাঁধে ভার ঝুলিয়ে ধান নিয়ে যেতেন। ধান থেকে চাল করা যে কি কষ্ট, সেটা আলীর মা-বাবা ছাড়া কেউ বুঝত না। আর আমরা আরামে খেতাম ঢেঁকিছাঁটা চাল।
রাতে আমরা যখন ঘুমাতে যেতাম, তখনো শুনতাম ঢেঁকিতে পার দেওয়ার শব্দ।

একটা গানের কথা মনে পড়ছে—
ও ধান ভানি রে
ঢেঁকিতে পার দিয়া
ঢেঁকি নাচে আমি নাচি
হেলিয়া দুলিয়া, ও ধান ভানি রে...
চাচা ও চাচির হেলিয়া দুলিয়া ধান ভানার কোনো অবকাশ ছিল না। তাদের বাড়িতে ঢেঁকিও নাচত না তারাও নাচতেন না। রাত জেগে ঢেঁকিতে পার দিয়ে যেতেন।

গোলাভরা ধান আর পুকুরভরা মাছ যে কোথায় ছিল খুঁজে পাইনি। সারাটা জীবন তারা স্বামী-স্ত্রী ঢেঁকিতে পার দিয়ে গেলেন। তাদের কি পা ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল!
ধীরে ধীরে চালকল শুরু হলো দাউদপুর বাজারে। ঢেঁকিছাঁটা চাল থেকে মানুষ ছুটতে লাগল চালকলে। চাল কুলায় ঝাড়ার পর বের হতো খুদ (ভাঙা চাল) কখনো কখনো চাচি (আলীর মা) খুদ চেয়ে নিতেন। খুদের চালের রান্নাকে বলা হতো খুদের ভাত। গরিবের খাবার। আরেকটা নাম ছিল খুদের ভাতের—বৌখুদা। আমাদের বাড়িতে বৌখুদা কালিজিরা দিয়ে পাটায় মাখানো হতো। এটা সাধারণত করতেন আমার ফুপাতো বোন বেগম আপা। সেটার স্বাদই ছিল আলাদা। আমরা মজা করে খেতাম।
মোল্লাবাড়িতে একটি মান্দারগাছ ছিল। মান্দারগাছের ফুল দিয়ে আমরা হাত রাঙাতাম। হাতের তালুতে ফুলটা ঘষলেই হাত রঙিন হয়ে উঠত।

প্রথম শাড়ি পরা কিশোরীদের দেখতাম পায়ে আলতা পরে বেড়াতে যেতে। যে মেয়েদের দেখেছিলাম আলতা পরে বেড়াতে—পরে জেনেছি তারা পায়ে আলতা লাগায়নি। পায়ে লাগিয়েছিল পুঁইশাকের পাকা বিচি। বিচিগুলো দুই আঙুলে নিয়ে চাপ দিলেই রস বের হতো। সেই রসই মেখেছিল দুই পায়ে। তাতেই তাদের কি আনন্দ! আলতা কেনার পয়সা ছিল না তাদের।

সুলতান দাদার বাড়িতে ছিল ইঁদারা। অনেকেই সেখান থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করত। ইঁদারার প্রতি আমাদের বেশ কৌতূহল ছিল। কারণে অকারণে আমরা সেই ইঁদারায় উঁকি মারতাম। বলতাম কুয়া। ইঁদারায় মাথা নিচু করে নানা শব্দ উচ্চারণ করতাম। সেই শব্দের প্রতিধ্বনি হতো। আমরা অবাক হয়ে শুনতাম। কখনো কখনো নিজের নামও বলতাম জোরে জোরে। পর মুহূর্তেই মনে হতো ইঁদারার ভেতর থেকে কেউ একজন রওশন রওশন বলে ডাকছে। পুরো গ্রামে একটাই ইঁদারা ছিল।

জোড়া তালগাছে বাসা বানাত বাবুই পাখিরা। বাবুই পাখিদের দেখতাম খেজুরগাছে এসে বসত। এরপর ঠোঁট দিয়ে খেজুরপাতা চিরে চিরে নিয়ে উড়ে যেত তালগাছে। সেই পাতায় তারা বাসা বানাত। আমরা মাথা উঁচু করে তাদের ঝুলন্ত বাসা দেখতাম।
আমি মাঝেমধ্যে দূরের মাঠে নাড়া (খড়) সংগ্রহ করতে যেতাম। ধান কাটা শেষে নাড়া সংগ্রহ চলত। নিজেদের খেত থেকেও আনতাম। আনতাম অন্যদের খেত থেকেও। এই নাড়া বাড়িতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নাড়া কুড়িয়ে সেগুলো দিয়েই বোঝা বাঁধা হতো। এরপর মাথায় করে নিয়ে আসতাম বাড়িতে। সেগুলো পালা (জড়ো করা) দিয়ে রাখা হতো পালানে (বাড়ির সামনের কোনো অংশ)।

গরুর গোবরও কুড়িয়েছি। যেসব জায়গায় গরু চরে বেড়াত, সেখানে ওড়া (বাঁশের তৈরি টুকরি) নিয়ে যেতাম। খেতে পড়ে থাকা গোবর হাত দিয়ে টুকরিতে তুলতাম। আমার সঙ্গে থাকত আরও কয়েকজন। কখনো কখনো গরু লেজ উঁচু করলেই আমরা দৌড়ে যেতাম গরুটার কাছে। বুঝতে পারতাম, গরুটা নাদবে (পায়খানা করবে)। যে আগে দৌড়ে যেতে পারত, সে তার টুকরি গরুর পাছায় ধরত। গোবরগুলো পড়ত তার টুকরিতে।
গোবর নিয়ে এসে চলত দ্বিতীয় পর্বের কাজ। গোবর মুঠি মুঠি করে রোদে শুকাতে দিতাম। পরে সেগুলো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

গ্রামে কাপালিরা আসত ঘোড়া নিয়ে। ঘোড়ায় বয়ে নিয়ে আসত মিষ্টি আলু। আমরা তাকে ঘিরে দাঁড়াতাম।
সেদ্ধ বা চুলার আগুনে পুড়িয়ে সেই আলু খাওয়া হতো। কখনো কখনো কাঁচাও খেতাম চিবিয়ে চিবিয়ে।
খালের পাড়ে ভয়লাদের ছিল বরইগাছ। কুল বরই। বরইয়ের ভারে ডাল নুয়ে পড়ত। সেই বরইয়ের প্রতি আমাদের ছিল ভীষণ লোভ। কয়েকজন মিলে ঢিল ছুড়তাম সেই গাছের দিকে। পাশেই ছিল একটি বেতঝোপ। ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে ঢিল ছুড়তাম। সে জন্য ভয়লার মায়ের লাল–নীল–কালো কত রকমের বকা যে খেয়েছি, তার হিসাব নেই।

তখন ভর সন্ধ্যাবেলা। বৈরাগী বাড়ির মাঠ। ছেলেবুড়ো সবাই বসে আছে মাঠে। হঠাৎ গাড়ির শব্দ। ধীরে ধীরে শব্দ বাড়তে থাকল। মাঠ থেকে সবাই দাঁড়িয়ে গেল। পিঁ পিঁ শব্দ হচ্ছে। মরা নদী পার হলেন দুজন লোক। মোটরসাইকেল দাঁড়াল মাঠের পাশে। যিনি মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন, তিনি খুব স্বাস্থ্যবান। সাইকেলে বসেই জানতে চাইলেন, ‘আনজুমদের বাড়িটা কোন দিকে?’
রামা বৈরাগী বললেন, ‘এই তো আনজুমের ভাই খাড়াইয়া আছে।’ লোকটা তখন আমাদের দিকে তাকালেন।

দৌলা জাহাজী জানতে চাইলেন, ‘আপনেরা কুথায় থাইকা আইছেন?’
পেছনের লোকটা বলল, ‘আমরা এসছি ঢাকা থেকে।’
চালক লোকটা বলল, ‘তুমি কি মোটরসাইকেলে উঠবে?’
কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বলে কি লোকটা। আমি মোটরসাইকেলে উঠতে জানি নাকি। জীবনে তো কখনো উঠিনি।

মাঠ থেকে আমাদের বাড়ি তিন মিনিটের পথ। মোটরসাইকেলটা আমাদের বাড়ির দিকে চলতে লাগল। আমি সেটার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছি। জীবনে প্রথম পেট্রলের গন্ধ খাচ্ছি। আহ কি যে ভালো লাগছে। লম্বা নিশ্বাসের সঙ্গে পেট্রল ঢুকে যাচ্ছে আমার পেটে।
আমাদের গ্রামে প্রথম একটি মোটরসাইকেলের প্রবেশ হলো। চারদিক থেকে আমাদের বাড়িতে লোকজন আসতে শুরু করল।

মেহমান দুজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। মোটা লোকটার নাম তালেব আলী। আমার বড় আপার ননদের হাজব্যান্ড। আর আরেকজন আপার দেবর, খোকন ভাই।
কেউ কেউ মোটরসাইকেল ছুঁয়ে দেখছে। আবার ছোট দাদি একজনকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘এই সইরা খাড়া। গাড়ি নারস ক্যান। নষ্ট হইয়া যাইবো না।’
পরের দিন আমার বেশ কদর বেড়ে গেল। সমবয়সীরা আমার কাছে নানা কিছু জানতে চাইল। ‘ওনারা তোর কী হয়। ওনারা কি খুব বড়লোক? তোদের বাইতে (বাড়িতে) কয়দিন থাকব’ ইত্যাদি।

খোকন ভাই আমাকে বেশ কয়েকবার মোটরসাইকেলে ওঠানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু না। আমি ভয়ের চোটে কিছুতেই উঠলাম না। তবে আনজুম ভাই, পুলক ভাই আর রফিক কাকা বেশ কয়েকবার সেটাতে উঠেছিলেন।
দুদিন পর খোকন ভাইরা ঢাকায় ফিরে গেলেন। যাওয়ার সময় অনেক লোক জড় হলো গ্রামের। সবাই তাদের বিদায় দৃশ্য দেখতে আসছেন। তালেব ও খোকন ভাই মোটরসাইকেলে উঠলেন। স্টার্ট দিলেন। পেছনের সাইলেনসার পাইপ দিয়ে ফুসফুস করে সাদা ধোঁয়া বের হলো। আহ কি অদ্ভুত গন্ধ! আমরা কয়েকজন বেশ খানিকটা পথ মোটরসাইকেলের পেছনে পেছনে দৌড়ালাম।