চোর নিধন

রাস্তায় হইচইয়ের শব্দ শুনে আমি দৌড়ে গেলাম বাড়ির বাইরে। বাড়ির ভেতর থেকে বাইরে গিয়ে দেখি অনেক লোকজন। সামনে ১০-১২ জন তরুণ। তার পেছনে পেছনে প্রায় ২০ জন শিশু-কিশোর।
তারা সবাই স্লোগান দিচ্ছে, ‘চুরি করা চলবে না। ডাকাতি করা চলবে না।’

আমি নিজেও সেই দলে শরিক হলাম। সবার মধ্যে দারুণ উত্তেজনা।
কিছুক্ষণ পরই বিষয়টা পরিষ্কার হলো। আমি যাচ্ছি চোর নিধন করতে। ঋষিপাড়া চুনিয়াপাতা গ্রামে।
কিছুদূর যেতেই আমাদের কানে এল ঢোল-টিকারার শব্দ। ঋষিরাই এসব বাজায়। আমরা মিয়াবাড়ি ডানে ফেলে কাজিবাড়ি পার হয়ে চুনিয়াপাতা গ্রামে পা রাখলাম।

অল্প পরেই আমরা একটি বাড়ি ঘিরে ফেললাম। দলের তরুণ কয়েকজন একটি ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। সদানন্দ নামে একজনকে টেনেহিঁচড়ে উঠানে বের করে আনল।
‘এ্যাই শালারে পিটা।’ কোত্থেকে ছুটে এল সবাই। সদানন্দকে কিল, ঘুষি থেকে শুরু করে সব রকমভাবে পিটাতে লাগল তরুণেরা।

ছুটে এল সদানন্দর কিশোরী মেয়ে রানু। তাকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। ছুটে এল তার ছোট ছেলে নিরঞ্জন। বাবা, বলে চিত্কার করে। তাকেও কেউ একজন টেনে নিয়ে গেল দূরে। ছুটে এল তাঁর স্ত্রী বাসন্তী। কেউ একজন চিত্কার করে বলল, ‘মাগী, চোরাই জিনিস খাইতে খুব ভালো লাগে। এহন বোঝ মজা।’

ভিড় ঠেলে এসে দাঁড়িয়েছেন সদানন্দের বাবা। করজোড়ে বলছেন, ‘বাবারা তুমাগো পায় পড়ি। আমার পুলাডারে জানে মাইরো না।’ কথা বলতে বলতে তিনি একজনের পায়ের ওপর পড়ে গেলেন। সদানন্দের বুড়ো মা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এলেন ভিড়ের কাছে। যেখানে সদানন্দকে এখন লাকড়ি দিয়ে পেটানো হচ্ছে। তিনি খুব চিত্কার করছেন। ‘বাবারে, আর মারিস নারে। বাবারে আর মারিস নারে।’
সদানন্দ জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। তখন শাস্তিদানকারী দলটি আরেক বাড়িতে হানা দিল।

চুনিয়াপাতা গ্রামে ৩০ ঘর ঋষি পরিবার থাকে। কেউ কেউ জুতা সেলাইয়ের কাজ করে। কোনো কোনো পরিবারের লোকজন ঢাকঢোল বাজিয়ে সংসার চালায়। কেউ কেউ খেতমজুর। কয়েকটি পরিবারের পুরুষেরা মুসলমান ও খ্রিষ্টানপাড়ায় চুরি করে। সিঁদেল চোর।

গ্রামের বেশ কয়েকজন তরুণ ঠিক করছে তারা চোরচোট্টাদের শায়েস্তা করবে। ঋষিপাড়ায় কান্নার রোল। আর্তচিত্কার। ছোটরা তাদের বাবাদের জন্য বুক ফাটিয়ে কান্নাকাটি করছে।
শিশুদের কান্না আমাদের সহ্য হচ্ছিল না। আমরা কয়েকজন কালীমন্দিরের কাছে এসে দাঁড়াই। কালীমাতা লম্বা জিব বের করে আছেন।

একজন চোর দৌড়ে পালাচ্ছিল। হাসান আলী বললেন, ‘এ্যাই ওকে ছেড়ে দে। ওকে মারিস না। ও চোর না। ও ঢাকি। ঢাক বাজায়।’
কিন্তু লোকটি হাসান আলীর কথা শুনল না। হয়তো তার কানে যায়নি। সে পেছন থেকে তাকে ল্যাং মারল। আর অমনি ঢাকি হালটের ওপর চিত্পটাং হয়ে পড়ে গেলেন। চিৎ হয়ে সে হাতজোড় করে বললেন, ‘দাদা, আমি চুর না। আমি ঢাক বাজাই। চৈত্রপূজার মেলায় ঢাক বাজাই। বিয়াতে ঢাক বাজাই। আমারে মাইরেন না।’

লোকটার নাম বদরুল। বদরুল তাঁর ডান পা তাঁর বুকের ওপর চেপে ধরল...।
আমরা দূর থেকে চোখ বন্ধ করলাম।
গ্রামের দক্ষিণ দিকে সড়ক। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুরব্বিরা নানা কথা বলছিলেন। তাঁরা বলেন, ‘এইবার ঘরের দরজা খুলে ঘুমানো যাবে। চোরচোট্টার দিন শেষ। কিন্তু শুধু খষিদের তো মারলে চলবে না। ওগো ওস্তাদরে মারতে হবে।’
তরুণের দল হইহই করে এগিয়ে আসছে সড়কের দিকে। পেছনে ফেলে আসছে আর্ত কান্না।

সড়কে পা দিয়েই একজন মুরব্বি বললেন, ‘পুঁটি মাছ তো মারলা, এইবার রাঘব বোয়ালদের ধর।’
তরুণেরা উত্তেজিত হয়ে পড়ল। তারা ছুটল নসির মিয়ার বাড়ির দিকে। যদিও সে বাড়িতে কেউ নেই। কয়েক দিন আগে সবাই পালিয়েছে। এলাকার সবাই জানে নসির মিয়া ঋষিদের দিয়ে চুরি করান। আর সেখান থেকে ভাগ বসান।
নসির মিয়ার বাড়ি পৌঁছে সবাই ঘড়বাড়ি ভাঙচুর করতে লাগল। কেউ একজন বলল, ‘এত শক্তি খরচ করার দরকার নেই। ঘর থিকা কেরোসিন তেল নিয়া আইছি। আগুন লাগাইয়া দেই।’
গ্রামের চোরচোট্টা, বদমাইশ সবাই ঠান্ডা হয়ে গেল।

বেশ কিছুদিন বাদে হঠাৎ রাতে গুলির শব্দ শুনলাম। তখন গভীর রাত। আমরা ছোটরা ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলাম। না ঘুমিয়েই আমাদের রাত কাটল। যত দিন যায় তত রাতে ডাকাতির ঘটনা বাড়তে থাকে। আমরা সকালে কৌতূহল নিয়ে শুনি কোথায় কোন বাড়িতে ডাকাতি হলো।

হরমুজ ভাই একদিন আমাদের বাড়িতে এলেন। বললেন, ‘সাবধানে থাইকেন। কহন যে কোন বাড়িতে হামলা দেয় তার ঠিক নাই। আগামীকাল থেকে গ্রামে পাহাড়া বসতেছে।’
মাকে হুরমুজ ভাই বললেন, ‘চাচি, আপনের বড় ছেলেকে দিতে হবে। সপ্তায় চার দিন রাইত জাইগা পাহাড়া দিতে হবে।’
বড় ভাই পর দিন থেকেই পাহারা দিতে শুরু করলেন।

বেশ কিছুদিন পরেও দেখা হলো ডাকাতি কমছে না। বেড়ে যাচ্ছে। রাতে যাঁরা পাহারা দেন তাঁরা বললেন, ‘ডাকাতদের কাছে বন্দুক। আর আমাদের কাছে লাঠি। কেমনে হবে?’
সেদিন ছিল শুক্রবার। গভীর রাত। আমাদের বাড়িতে ডাকাত পড়ল। ডাকাতেরা বাড়ির বড়দের দুই হাত পেছন দিকে নিয়ে বেঁধে ফেলল। তারা মায়ের কাছ থেকে সব জিনিসপত্র বুঝে নিচ্ছে। কোথায় টাকা, কোথায় স্বর্ণ—সব বের করে দিচ্ছেন মা। মায়ের পেছন পেছন একজন বন্দুক নিয়ে ঘুরছে।

ডাকাতদের সবারই মুখে কালো কাপড় বাঁধা। হঠাৎ একজনের মুখ থেকে কালো কাপড় খুলে গেল। আমি স্পষ্ট চিনতে পারলাম সদানন্দকে যে লোকটি খুব মারছিল, সেই লোকটা। আমি কালো কাপড়টা হাতে নিয়ে উঁচু করে ধরলাম। সে আমার হাত থেকে কাপড়টা ছিনিয়ে নিয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম যারা ডাকাতি করছে, যারা চোরদের মেরেছিল তারা। তাদের গলার আওয়াজ আমার চেনা লাগল।
আমাদের বাড়ির সবকিছু নিয়ে গেল।

পরের দিন ভোরবেলা অনেক লোক আমাদের বাড়িতে ভিড় করল। ডাকাতি হওয়া বাড়ি তারা দেখতে এসেছে। তাদের মধ্যে আমি সেই ডাকাতকেও দেখতে পেলাম। মাকে সে জিজ্ঞেস করল, ‘খালাম্মা, কাউকে চিনতে পারছেন?’
মা যেন রাতের মতোই ভয় পেয়ে গেলেন। কেঁপে কেঁপে বললেন, ‘না বাবা, রাতের অন্ধকারে কাউকে চিনতে পারি নাই।’