জোনাক জ্বলে ডালিমগাছে

মা সাপ্তাহিক একটা শাসনের আয়োজন করতেন। পুরো সপ্তাহ আমরা তিন ভাই কী কী দুষ্টামি-অন্যায় করেছি, তার ওপর শাস্তি নির্ভর করত। দিনের বেলা শাসনের তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। মা আমাদের মারতে এলেই আমরা দৌড়ে পালাতাম। দৌড়ে দূরে কোথাও চলে যেতাম। তার হাতে থাকত একটা লাঠি। আমরা যখন দৌড়াতাম, মা পেছন থেকে বলতেন, ‘আর কই যাইবা। রাইতে মুরগি খোঁয়াড়েই আসতে হবে।’ তার মানে, রাতে তো বাড়িতে ফিরতেই হবে। তখন তিনি শাস্তি দেবেন।

একদিন সন্ধ্যার পর আমরা চৌকিতে বসেছি। মা শাস্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একটি শীতল পাটি ভাঁজ করে হাতে নিলেন। তারপর বড় ভাইকে দিয়ে শুরু করলেন। ঠাস ঠাস করে বাড়ি দিচ্ছেন তাকে। চৌকির সামনেই জ্বালানো ছিল কুপিবাতি (প্রদীপ)। পিতলের একটা পিলসুজের (স্ট্যান্ড) ওপর কুপিবাতিটা রাখা। মা মেজ ভাইকেও মারলেন। এবার আমার পালা। আমার ডান পাশেই ছিল কুপিটা। যেই আমাকে মা মারতে যাবেন, আমি আর দেরি না করে কুপিবাতিটা এক ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলাম। সারা ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। মা আমার কাণ্ড-কীর্তি দেখে অবাক হয়ে গেলেন। আমাকে আর অন্ধকারে মারতে পারলেন না। কোথায় মারবেন, ছেলের চোখেমুখে না আবার আঘাত লেগে যায়।

মানিকদের গাবগাছে ছিল একটা বকের বাসা। একদিন আমি আর রনটু গিয়ে দেখি বাচ্চা হয়েছে। আর দেরি করা যায় না। বকের বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। কানি বকের বাচ্চা খাঁচায় না পাললেই চলত। বাচ্চাকে শুধু মাছ খাওয়াতে পারলেই সে খুশি। তিন বেলা মাছ খাওয়াতে পারলেই হতো।

আস্তে আস্তে বকের বাচ্চা বড় হয়ে গেল। উড়তে শিখল। কিন্তু বাড়ি থেকে কোথাও যায় না। বাড়ির বিভিন্ন গাছের ডালে গিয়ে বসে থাকে। মাছ নিয়ে ডাকলে উড়ে চলে আসে কাছে। মাছ ছুড়ে দিলে টপাটপ গিলে ফেলে।
একবার বন্যা হলো। কোথাও আর মাছ ধরতে পারছি না। সারা দিন বক দুটো আমার পেছন পেছন ঘুরত। এক বেলাও মাছ দিতে পারছি না। হাতে বড়শি নিয়ে ঘুরছি কিন্তু কোনো মাছ ধরতে পারছি না।

বক দুটো আমার সামনে এসে হাঁ করছে। তার মানে, খাবার দাও। কোনো খাবার নেই। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। চিন্তায় পড়ে গেলাম, কী করা যায়। একদিন ঘর থেকে নিয়ে এলাম মটরকলাই। বকের দুই ঠোঁট ফাঁক করে সেগুলো ঢেলে দিলাম ওর মুখে। কিন্তু সে কিছুতেই ওসব খাবে না। বেশ কয়েক দিন কেটে গেল। মাছের জোগাড় করতে পারছি না। হঠাৎ একদিন দেখি আমগাছে বক নেই, যেখানে তারা প্রায়ই বসে থাকত। খাদ্যের সন্ধানে কোথায় যে চলে গেল, তাদের আর খুঁজে পাওয়া গেল না।

আব্বা এসেছেন কলকাতা থেকে। আব্বা এলে গমগম করত বাড়ি। আমাদের মধ্যে ভিন্ন ধরনের আমেজ শুরু হতো। আব্বার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া, একসঙ্গে সাঁতরানো—সে কী আনন্দ!
একদিন ঘুম থেকে উঠেই দেখি আব্বা আর মা কেবিনের সামনে বসে আছেন। দুজনের হাতে দুটো সিগারেট। দুজনেই সিগারেটে টান দিচ্ছেন। আমার নাকে এসে লাগছে সিগারেটের গন্ধ। আমি কিছু দেখতে পাইনি, এমনভাবে চোখ বন্ধ করলাম। মাঝেমধ্যে চোখ পিটপিট করে দেখলাম মা সিগারেট টেনেই যাচ্ছেন।

আব্বা বাড়িতে এলে আব্বার সঙ্গে মা-ও মাঝেমধ্যে সিগারেট খেতেন। আব্বার শরীরে ছিল একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ। তাঁর ব্যবহৃত তোয়ালেতেও এ রকম গন্ধ ছিল। আমরা বলতাম কলকাতার বাসনা (গন্ধ)।
কত দিন আমরা বসে থাকতাম পিয়নের আশায়, আব্বার চিঠির জন্য। মা বসে থাকতেন বারান্দায়। খাকি পোশাক পরা পিয়ন দেখলেই আমরা দৌড়ে যেতাম।

আমাগো চিঠি আছে?
পিয়ন ধাই ধাই করে হেঁটে যেতেন। আব্বার চিঠি নেই। অনেক দিন পরপর আব্বা চিঠি লিখতেন।

বড় আপার বিয়ে হলো টাঙ্গাইলে। নাগরপুর থানার টেংরিপাড়া গ্রামে। বিয়ে হলো মহা ধুমধামে। দুলাভাই বিএ পাস। বিএ পাসের জন্য আমার ভাবির (তারা বিবি) সে কী গর্ব। গ্রামে কোনো মেয়ের বিয়ে হলেই তিনি আগবাড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন, তোমাগো মাইয়ার জামাই কী পাস?
একজন বলছিলেন, ম্যাট্রিক ফেল।

ভাবি সে কথা শুনে অবজ্ঞার ভঙ্গিতে মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করেছিলেন।
পুত।
একবার গ্রামের মেম্বার বাঁশি মিয়াকে কারা যেন রাতের আঁধারে কুপিয়ে চলে গেল। তারা ঢুকেছিল ঘরে সিঁধ কেটে। তাকে ভর্তি করা হলো ঢাকায়। তার নাকও কেটে গিয়েছিল।

আমরা শুনলাম তাঁর রক্ত লাগবে। রক্ত দেবে আমোদ ভাই। আমাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছিল বুঝতে রক্ত কীভাবে দেয়। বড়রা আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। তখন আহত বাঁশি মিয়ার চেয়ে আমোদ ভাই-ই আলোচনায় উঠে এলেন।
বাঁশি মিয়া সেরে উঠলেন। তবে তাঁর নাকে একটা কাটা দাগ রয়ে গেল। যদিও গ্রামে ছিলেন তিনি প্রচণ্ড প্রতাপশালী। তবু আড়ালে-আবডালে তাঁকে কেউ কেউ বলতেন নাককাটা বাঁশি মিয়া।

গ্রামে কারও বাড়িতে কিছু চুরি হলে বা খোয়া গেলে ‘চটিপড়া’ দেওয়া হতো। কয়েকটা গ্রুপ ছিল চটিপড়া দেওয়ার। বাঁশের লম্বা চটি নিয়ে আসত তারা। দুই দিকে দুজন চটির দুই মাথা ধরতেন। তারপর চটি ধরে হাঁটা শুরু করতেন। চটি নিয়ে তাঁরা যে বাড়িতে যাবেন, মানে ওই বাড়ির কেউ চুরি করেছে। তবে চটিপড়ায় কোনো চোর ধরা পড়েছিল বলে শুনিনি।

মোহন বিশ্বাসের স্ত্রী ছিলেন খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তাঁকে আমরা বলতাম নানিবুজি। তাঁর বাড়িতে বাঁশের আড়ায় ঝোলানো থাকত শত ডুমা (ন্যাকড়া)। একটি ন্যাকড়া দিয়ে তিনি ডান পা মুছতেন। আরেকটা দিয়ে বাঁ পা। আবার আরেকটা দিয়ে মুখ মুছতেন। আরেকটা দিয়ে নাক মুছতেন। এমনি করে তাঁর অনেক ন্যাকড়া লাগত। তাঁর বাড়িতে গেলে বলতেন, মিয়া বাই, কেমন আছ? মাঝেমধ্যে গুড়-মুড়ি খেতে দিতেন। তাঁর ঘরের বারান্দায় থাকত তামার ঝকঝকে একটা বদনা। ওই বদনার পানি দিয়ে তিনি অজু করতেন।

তাঁর এক বোন থাকতেন সুজাপুরে। তাঁরা দুই বোনই দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন। তাঁকেও আমরা ডাকতাম নানিবুজি। তাঁর বাড়িতে গেলেই আমাদের বেতের কাঠায় ভরে দিতেন গুড়, মুড়ির মোয়া কত কিছু। আমরা সেসবের লোভেই যেতাম সেই নানিবুজির বাড়ি।

মাঝেমধ্যে ঢাকা থেকে যেতেন আমার দুই মামা (মায়ের চাচাতো ভাই) একজনের নাম মনিরুল হক। আরেকজনের নাম আইনুল হক। সুজাপুর থেকে তাঁরা আমাদের বাড়ি বকচরে আসতেন।
এসে আমাদের দেখলেই বলতেন, আসো মামা, দুইটা অঙ্ক কষি। এ কথা শুনে আমার পিলে চমকে যেত।

তাই আমি খোঁজখবর রাখতাম মামারা এসেছেন কি না। যদি শুনতাম মামারা বাড়িতে এসেছেন, তাহলে আমার খবর হয়ে যেত। পাশাপাশি গ্রাম। তাঁরা আমাদের বাড়িতে আসতেন সাধারণত বিকেলবেলা। বাড়িতে আসবেন, এ কথা শুনলেই আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতাম। তাঁরা ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত বাড়িতে ঢুকতাম না।

আমাদের দুয়ারে (উঠোনে) ছিল একটি ঝাপরানো ডালিমগাছ। প্রতিবছর অনেক ডালিম হতো। মা তাঁর নিজের হাতে সেটি লাগিয়েছিলেন। ডালিম পেকে যখন ফেটে যেত, তখন আমরা সেগুলো ছিঁড়তাম। রাতের বেলা ঘন অন্ধকারে দেখতাম ডালিমগাছে জোনাক পোকার আলো মিটিমিটি জ্বলছে। ঘরের দরজা খুলে সেগুলো ধরতে যেতাম। ছোটবেলায় ওটা ছিল আমার কাছে এক বিস্ময়। কীভাবে একটা পোকার শরীরে আলো জ্বলে! কখনো ধরতে পারতাম, কখনো পারতাম না। হাতের তালুতে নিয়ে সেটা নাড়াচাড়া করতাম। একবার বাড়ির কে যেন দরজায় আঠা দিয়ে একটি জোনাক পোকা সেঁটে দিয়েছিল।

আমার ফুফু একদিন বললেন, বাবুই পাখি রাতে কীভাবে চোখে দেখে, জানিস?
আমরা ভাইবোনেরা বললাম, না।
ফুফু বললেন, বাবুই পাখিরা ওদের বাসায় আঠা দিয়ে জোনাক পোকা লাগিয়ে দেয়। সেই আলোতে ওরা দেখতে পায়।

আমরা তো ফুফুর কথা শুনে অবাক।
প্রায় রাতেই আমাদের বাড়িতে জোনাক পোকার আগমন ঘটত।