বাবার জুতা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল


ঢাকা শহর। এলিফ্যান্ট রোডের ধারে জুতার দোকান। গ্লাসঘেরা দোকান। বাইরে থেকে সব দেখা যায়। চকচক করছে নানা রকমের জুতা।
বাইরে দাঁড়িয়েছিল রমিজ। তার খালি পা। সে ভেতরে দেখল এক ভদ্রলোককে। তিনি জুতা কিনছেন। দোকানের লোকটা তাঁকে জুতা পরিয়ে দিচ্ছেন। বাবার কথা মনে পড়ল ওর। বাবার কোনো জুতা নেই।
দোকানের লোকটা ভদ্রলোকের পুরোনো জুতাটা প্যাকেট করে দিলেন। লোকটা নতুন জুতা পরে বের হলেন।
কিছু দূর এগিয়েই তিনি পুরোনো জুতার প্যাকেটটা ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন।
রমিজ এদিক-ওদিক তাকাল। আর সেটা ডাস্টবিন থেকে তুলে নিয়ে দৌড়াতে লাগল।
একটা বস্তির খুপরি ঘরে তারা থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে ঘেমে যায় সে। বাসার সামনে গিয়েই দেখল, বাবা ঘর থেকে বের হচ্ছেন।
রমিজ বলল, ‘বাবা, তোমার জন্য জুতা এনেছি।’
বাবা আগ্রহ নিয়ে জুতার প্যাকেট হাতে নিল। তারপর সেটা খুলে ফেলল। কিন্তু জুতাজোড়া পায়ে দিয়ে দেখেন ছেঁড়া, পরা যাচ্ছে না।
বাবা ধমকে উঠলেন, ‘বাবার সঙ্গে ফাজলামি। বেয়াদব ছেলে।’ এ কথা বলেই ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলেন রমিজের গালে।
রমিজ কাঁদতে কাঁদতে চলে এল বাসার বাইরে। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল একটি পার্কে। তার মন খুব খারাপ। একা একা সে হাঁটছে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে, একটি লোক পার্কের বেঞ্চে বসে আছেন। বেঞ্চের নিচে একজোড়া কালো জুতা। লোকটা বসে বসে ঝিমাচ্ছেন। রমিজ এদিক-ওদিক তাকায়...। তারপর আস্তে আস্তে সেদিকে এগিয়ে যায়। পা টিপে টিপে সেখানে গিয়েই জুতা নিয়ে দে দৌড়। রমিজের পায়ের শব্দে লোকটার ঘুম ভেঙে যায়। রমিজের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে থাকে।
‘চোর চোর। আমার জুতা নিয়ে গেল।’
কোত্থেকে লোকজন ছুটে আসে। রমিজ প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই ওই লোকজনের সঙ্গে পেরে ওঠে না। তারা তাকে ধরে ইচ্ছেমতো পিটুনি দিতে থাকে।
অনেক পিটুনি খেয়ে ১২ বছরের রমিজ ছাড়া পায়। তার ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়েছে। বাঁ পা’টা মচকে গেছে।
ঘরে ফেরার পর মা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন।
‘কী হয়েছে তোর। কোথায় গেছিলি।’
রমিজ বলে, ‘চুরি করতে।’
চুরির কথা শুনে মা তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন।
‘কী বললি, চুরি করতে গেছিলি? কী চুরি করতে গেছিলি?’
‘বাবার জন্য জুতা চুরি করতে গেছিলাম।’
ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে সে ঘরে ঢোকে। সারা শরীরে তার ব্যথা। ভীষণ ক্লান্ত। ছোট চৌকির ওপর শুয়ে পড়ে সে।
রমিজের বাবা আসে রাতের বেলা। হাতে একটা প্যাকেট।
রমিজের মা জিজ্ঞেস করে, ‘কী আনলেন?’
‘জুতা। আমার জন্য একজোড়া জুতা নিয়ে আসলাম।’
মা বলেন, ‘ভালো করছেন। আপনার জন্য জুতা চুরি করল ছেলে।’
রমিজের বাবা আলাউদ্দিন জুতার প্যাকেটটা চৌকির ওপর রেখে দিলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে যেন রমিজের চোখে পড়ে সেটা।
পরের দিন ভোরবেলা। চোখ কচলাতে কচলাতে রমিজ ঘুম থেকে উঠল। চোখে পড়ল প্যাকেটটা। চিৎকার করে বলল, ‘বাবা, এই প্যাকেটটায় কী?’
বাবা শুয়েছিলেন একই চৌকিতে। বাবা ডান কাত থেকে বাঁ পাশ ফিরে শুয়ে বললেন, ‘জুতা। আমার জুতা। আমার জুতার জন্য তোকে আর চুরি করতে হবে না।’
‘বাবা, আমি খুলে দেখি?’ রমিজ বলে।
‘হ্যাঁ, দেখ।’
প্যাকেটটা খুলেই রমিজের চক্ষু ছানাবড়া। ‘বাবা, এত ছোট জুতা ক্যান। এটা তো তোমার পায়ে লাগবে না?’
বাবা এবার চৌকি থেকে উঠে বসলেন। বললেন, ‘তোর পায়ে লাগলেই তো হলো। এটা তো তোর জন্য এনেছি।’