মহাপুরুষ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল


অনেক রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। পাশের বাসার কেউ একজন ভীষণ কান্নাকাটি করছে। মনে হচ্ছে আমার বয়সীই হবে।
আমরা গতকাল এ বাসায় উঠেছি। আজই এ বাসায় প্রথম রাত।
ছেলেটার কান্না আরও বাড়ছে। আমি আম্মুকে ডাকছি। ‘আম্মু, ওঠো ওঠো। পাশের ফ্ল্যাটে যেন কী হয়েছে।’
আম্মুর সহজেই ঘুম ভেঙে গেল।
‘তাই তো, কী হলো ছেলেটার।’
আম্মু আমাকে বললেন, ‘চল তো, দেখে আসি।’ আম্মু কলবেল বাজালেন। একবার, দুইবার, তিনবার।
ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক দরজা খুললেন।
আম্মু বললেন, ‘আমরা নতুন ভাড়াটে।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘জি। বুঝতে পেরেছি।’
আমি দেখলাম ছেলেটা তার মায়ের লম্বা চুল ধরে টানছে আর চিৎকার করে কাঁদছে। ওর মা অসহায়ের মতো বলছেন, ‘ছাড়, বাবা। ছাড়। মরে গেলাম।’
ছেলেটা আমার বয়সীই । আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি।
ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনাদের তো অনেক ধকল গেছে। সারা দিন জিনিসপত্র টানাটানি করতে হয়েছে। আপনি যান শুয়ে পড়ুন। এটা প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা আমাদের।’
আম্মু আমার হাত ধরে ঘরে নিয়ে এলেন। এসে দেখি বাবা ঘুম থেকে উঠেছেন। ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালছেন।
আম্মু বললেন, ‘তুমিও উঠে পড়েছ?’
‘হ্যাঁ, প্রতিবন্ধী ছেলেটার চিৎকারে আর থাকতে পারলাম না।’
‘তুমি কী করে জানলে?’ বাবা বললেন, ছেলেটার বাবার সঙ্গে সন্ধ্যায় পরিচয় হলো। গড়গড় করে তাঁর ছেলের কথা সব খুলে বললেন। একটাই ছেলে। ছোটবেলা থেকেই নাকি এ রকম। বড্ড মুশকিলে পড়া গেল।’
মা বললেন, ‘মুশকিল মানে?’ বাবা বললেন, ‘প্রতিদিন যদি এমন হয়। তাহলে তো আমার ঘুম হারাম হয়ে যাবে।’
আম্মু কথাটা ভালোভাবে নিলেন না। বললেন, ‘তুমি শুধু তোমার ঘুমের কথাটাই চিন্তা করলে?’
বাবা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে শুতে গেলেন। আমার মনটা ভীষণ খারাপ হলো ছেলেটার কথা ভেবে।
সকালবেলা আমি স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হয়েছি। আমার চোখ গেল পাশের ফ্ল্যাটের দিকে। দেখি সেই ছেলেটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। মুখ দিয়ে সামান্য লালা ঝরছে।
বললাম, ‘তোমার নাম কী?’
ছেলেটা কোনো উত্তর দিল না। একটু পরে বলল, ‘আমার দড়ি খুলে দাও।’ কথাগুলো তার মুখে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি দেখলাম ওর কোমরে দড়ি বাঁধা। ওই সময় ওর আম্মু বের  হলেন। আমি বললাম, ‘আন্টি, ওকে বেঁধে রেখেছেন কেন?’
‘আর বোলো না, বাবা, লোকজনকে মারধর করে। আমাকে তো করেই। কালকে রাতে দেখলে না?’
আমি  স্কুলে চলে গেলাম। ক্লাসে সারাক্ষণ ছেলেটার কথা মনে পড়ল। আমার মন খারাপ হয়ে থাকল।
স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে আমার বিকেল হয়ে যায়। ঘরে ঢুকেই বুঝলাম আম্মু আর বাবা মুখ ভার করে আছেন। তখনই পাশের বাসার ছেলেটির চিৎকার শুনতে পেলাম।
বাবা বললেন, ‘তুমি দেখেশুনে বাসা নেবে না? এ রকম একটি পরিবেশে থাকা যায়?’
আম্মু বললেন, ‘আশ্চার্য, আমি সেটা জানব কী করে। আর তুমি ভেবে দেখো আমাদের সন্তানও তো এ রকম হতে পারত?’
কথা শুনে বাবা চুপ করে গেলেন। আম্মু আমাকে দেখে বললেন, ‘কখন এলি তুই?’
ছেলেটির নাম আবরার। বাবার কাছে আমি সব ঘটনা শুনলাম। আবরার ছোটবেলা থেকেই এ রকম। কখনো ভালো, কখনো আবার অসুস্থ হয়ে যায় সে।
আবরারের বাবা ছেলের জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তার কারণ আবরারের মা ওকে একা সামলাতে পারেন না। দেশের জমি বিক্রি করে এখন তাঁদের সংসার চলে।
পরের দিন দুপুর। আবরারের বাবা এলেন আমাদের বাসায়। বাবার সঙ্গে কথা বলে আবরারের বাবা হু হু করে কেঁদে ফেললেন।
বাবা আঙ্কেলকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু আঙ্কেলের কান্না আরও বেড়ে গেল।
আঙ্কেল বললেন, ‘ভাইসাব, আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে লাভ নেই। আবরার তো আর ভালো হবে না কোনো দিন।’
বাবা চুপ করে থাকেন। আঙ্কেল কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, ‘আমরা বিয়ে–শাদি, জন্মদিন কোথাও অ্যাটেন করতে পারি না। কোথাও বেড়াতে  যেতে পারি না। ওকে কোথাও নিয়ে যাই, সেটাও কেউ পছন্দ করে না।’
হঠাৎ আবরার কোত্থেকে দৌড়ে এল। আমাদের বাসায় ঢুকেই বাবাকে জাপটে ধরে ফেলল। ওর বাবা যেই ধরতে গেছে আর আবরার অমনি ওর বাবার পেটে একটা ঘুসি মেরে বসল। আঙ্কেল ভীষণ ব্যথা পেয়ে কঁকিয়ে উঠলেন। বললেন, ‘ভাইসাব। এর সঙ্গে পারা যায় না। শরীরে পশুর মতো শক্তি।’
অনেক কষ্টে আঙ্কেল আবরারকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেন। আর তখন সে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
দুদিন পরের কথা। আম্মুর সঙ্গে আমি গেলাম আবরারদের বাসায়। দরজার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আম্মু বললেন, ‘আজ আমার ছেলের জন্মদিন। সন্ধ্যায় একটু আসবেন, আপা।’
আন্টি বললেন, ‘সে সুযোগ যে নেই। আবরার এই ভালো, এই মন্দ।’
আমি জানতে চাইলাম, ‘আন্টি, ও এখন কী করছে?’
‘এখন টেলিভিশনে কার্টুন ছবি দেখছে।’
‘আমি ভেতরে আসি?’
‘আসো, তবে বাবা ওর থেকে দূরে দূরে থাকবে। কখন কী করে বসে।’
আমি সাহস করে ভেতরে গেলাম। দেখি সে টেলিভিশনের পর্দার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। আমি কয়েকবার ডাকলাম। ‘আবরার, আবরার।’ সে যেই আমার দিকে তাকিয়েছে—আমি বললাম, ‘আজ আমার জন্মদিন। কেক কাটব, যাবে?’
সে আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
সন্ধ্যাবেলা বড় খালা, দিদা, নানু এলেন। আম্মু একটা বড় কেক নিয়ে এসেছেন। বাবা ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত। কেক কাটার ছবি তুলবেন। মা একটা পিচ্চি খেলনা বের করলেন। আমি বললাম, ‘এই খেলনা দিয়ে আমি কী করব? এটা তো ছোটদের।’
মা বললেন, ‘এটা আবরারের জন্য।’
‘ও তো আমার সমান, আম্মু।’
আম্মু বললেন, ‘ও বড় হলেও ছোটদের মতো। যাও এটা দিয়ে এসো।’
আমি দৌড়ে গিয়ে খেলনাটা আবরারের হাতে দিতেই সে বেশ খুশি হলো। চিৎকার করতে থাকল, ‘মা, মা, বাবা, বাবা।’
আমি ফিরে এলাম বাসায়। আমার বেশ আনন্দ হচ্ছে আবরারের খুশি দেখে।
বাবা বললেন, ‘চলো, কেক কাটার পর বাসাটা দেখে আসি।’
আম্মু বললেন, ‘কোন বাসা?
বাবা বললেন, ‘নতুন একটা বাসা দেখে এসেছি। খুব ভালো বাসা। ভাড়াও কম।’
মা রেগে বললেন, ‘আমি আপাতত এ বাসা ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।’
বাবা বললেন, ‘এ রকম একটা অসুস্থ পরিবেশে কীভাবে থাকবে?’
দিদা বললেন, ‘বাসার কথা বাদ। এখন কেক কাটো। রাত হয়ে যাচ্ছে।’
মোমবাতি জ্বালানো হলো। আমার হাতে কেক কাটার ছুরি দেওয়া হলো। সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ, পাপাই’।
বাবা বলবেন, ‘কই বাপী ফুঁ দাও। কেক কাটো।’
আমি বাবা আর আম্মুর দিকে তাকালাম। আস্তে আস্তে বললাম, ‘আম্মু, কেকটা আবরারদের বাসায় নিয়ে যাই। ওদের বাসায় কাটি?’
বাবা বললেন, ‘এ যে দেখছি মহাপুরুষ। চলো চলো যাই।’
আম্মু বললেন, ‘গুড আইডিয়া। চলো, চলো।’ এ কথা বলেই আম্মু পাশের বাসায় দৌড়ে গেলেন। মুহূর্তে ফিরে এসে বললেন, ‘আবরার আজ বেশ ভালো আছে। ওর মেজাজ বেশ ঠান্ডা। চলো।’
আম্মু কেকটা নিয়ে আবরারদের বাসার দিকে ছুটলেন। আমরা সবাই আম্মুর পেছন পেছন গেলাম।
বাবা নানুর কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘আপনার মেয়ে একটা আস্ত পাগল।’
কথা শুনে নানু হাসলেন।
বললেন, ‘তোমারও পাগল হওয়া উচিত। তাহলে আরও ভালো হয়।’