অনুষ্ঠান উপস্থাপনা

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
ফাইল ছবি

একটি অনুষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি উপস্থাপক। তাঁর প্রতিভা ও সজীবতার পরিমাণ আর অনুষ্ঠানের সাফল্য মোটামুটি সমান। ভালো উপস্থাপক তিনিই, যিনি তাঁর নিজের তৈরি অনুষ্ঠানের চেয়ে বড়, ইচ্ছা-আনন্দের যিনি দর্শকদের রহস্যময় অচেনা পথে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।

জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ উপস্থাপনার বেলায়ও তা-ই। সবাই উপস্থাপক নন, কেউ কেউ উপস্থাপক।

অনেকে ঘোষক ও উপস্থাপক এক মনে করেন। ভাবনাটা একেবারেই ভুল। ঘোষণা ‘কথা’র ব্যাপার, উপস্থাপনা ‘ব্যক্তিত্বে’র ব্যাপার। উপস্থাপক কেবল অনুষ্ঠানের পাত্র-পাত্রীদের নাম ঘোষণা করেন না, নিজের ব্যক্তিত্ব ও বিভায় গোটা অনুষ্ঠানকে আলোকিত করে রাখেন। অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্যেও তিনি বিখ্যাত, এর বেগবান জীবনপ্রবাহের মূল পরিচালনাকারী। তাঁর ভেতরকার তীক্ষ্ণ রসবোধ, সজীবতা, বিদ্যাবুদ্ধি, প্রতিভা, কল্পনাশক্তি ও স্বতঃস্ফুর্ততায় তাঁর অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত। তাঁর মননের আলো একে অর্থ দেয়। তিনি একই সঙ্গে এর স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার। ফুল, পাতা আর ডাল অপরূপভাবে সাজিয়ে ইকেবানা শিল্পী যা রচনা করেন, অনুষ্ঠানের উপকরণগুলো দিয়ে উপস্থাপকও করেন তা-ই। অনুষ্ঠানে যা যা উপস্থাপিত হবে, তা যদি দামি, উজ্জ্বল বা বর্ণাঢ্যও হয় কিন্তু উপস্থাপক হন মেধাহীন ও অসার, তবে সেই বিশাল সম্ভার নিয়েও গোটা অনুষ্ঠান নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে। কিন্তু উপস্থাপক যদি হন সপ্রতিভ ও জীবনসঞ্চারী, তবে অনেক সাধারণ জিনিস দিয়েও তিনি অনুষ্ঠানকে অসাধারণ করে তুলতে পারেন।

গত ৫০ থেকে ৬০ বছরে উপস্থাপনা ব্যাপারটা নিয়ে পৃথিবীতে অনেক চিন্তাভাবনা হয়েছে। চিহ্নিত হয়েছে এর বিভিন্ন উঁচু-নিচু তল। সেই অনুসারে উপস্থাপকদের নানা রকম নামকরণও হয়েছে। কখনো এঁদের নাম হয়েছে কম্পেয়ার, কখনো প্রেজেন্টার, কখনো অ্যাংকরম্যান, কখনো হোস্ট। আজ বাণিজ্যিকায়নের অন্তঃসারশূন্য ও অসম্মানজনক যুগে এঁদের নাম হয়েছে ‘ভিডিও জকি’। রূপের ডালি সাজিয়ে বা চোখধাঁধানো ফালতু কথার আলতো চমক দিয়ে যাঁরা দর্শকদের যেনতেনভাবে বাগে আনেন, তাঁরাই ভিডিও জকি।

উপস্থাপনা কী, উপস্থাপকের গুণাবলি কী, আজ তা যেমন মোটামুটি শনাক্ত হয়েছে, তেমনি কী করে উপস্থাপক গড়ে তোলা যায়, সে পদ্ধতিরও উন্নতি ঘটেছে।  আজ প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঝারি উপস্থাপককে ভালো উপস্থাপক বা ভালো উপস্থাপককে আরও ভালো উপস্থাপক করে গড়ো তোলা যায়।  তবু আমার ধারণা, টেলিভিশনের যত রকম শিল্পী আছেন, তাঁদের মধ্যে প্রশিক্ষণের ব্যাপারটা সবচেয়ে কম কাজে আসে উপস্থাপকদের বেলায়। টিভিতে গান গাইতে চাইলে গায়ককে গানটি আগে থেকেই গলায় তুলে নিতে হয়, অভিনয় করতে হলে অভিনেতাকে ভালো করে রিহার্সাল দিতে হয়। সংলাপ আত্মস্থ করতে হয়। এসব যত ভালো করে করা যাবে, গান বা অভিনয় তত ভালো হবে। কিন্তু উপস্থাপনার এসব বাঁধাধরা রেওয়াজ বা রিহার্সাল খুব একটা কাজে আসে না।  উপস্থাপনা একটা স্বতঃস্ফূর্ত ও উপস্থিতভাবে জন্ম নেওয়া দ্যুতিময় শিল্প, অনুষ্ঠানের সময় নানান ঘটনাবৈচিত্রে্যর ভেতর দিয়ে তার তাৎক্ষণিক বিকাশ।  উপস্থাপকের রিহার্সাল, স্টেজ রিহার্সাল, মঞ্চাভিনয়—সব একটি জায়গা—পর্দায়। এর আগে তাঁর প্রায় কিছুই নেই। পর্দায় দর্শকের সামনে দিনের পর দিন ঠেকে ঠেকেই তাঁকে উপস্থাপনা শিখতে হয়।

আমরা যখন অনুষ্ঠান শুরু করি, তখন দেখা গেল প্রথম অনুষ্ঠানে একটা বড় ধরনের ভুল করে বোকা হলাম। দ্বিতীয় অনুষ্ঠানে (আগের ভুলটা সম্বন্ধে হুঁশিয়ার থাকায়) ওই ভুলটা আর করলাম না। কিন্তু নতুন আরেকটা ভুল করে আবার বোকা হলাম। এভাবে বোকা হতে হতে আমরা চালাক হতাম।

কী করে একজন উপস্থাপক দর্শকের অন্তরঙ্গ মানুষ হবেন

এ ব্যাপারে যে গুণটি তাঁর সবচেয়ে জরুরি তা হচ্ছে, সহজ হওয়া। সাধারণ হওয়া। তাঁর মধ্যে মেকি বা বানোয়াট কিছু না রাখা। দর্শকের মনে নিজের ব্যাপারে পুরো নিরাপত্তার ভাব জাগিয়ে তোলো; নিজেকে কেউকেটা বানিয়ে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা তাঁর জন্য ক্ষতিকর। তাঁদের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে যেতে হবে। বুঝতে দিতে হবে: দূর আকাশের কোনো তারকা তিনি নন। তিনি তাঁদেরই একজন; দর্শকেরা তাঁদের শিক্ষা, রুচি, সম্মান, মর্যাদা নিয়ে তাঁর কাছে পুরোপুরি নিরাপদ। এই করার জন্য তাঁর যা দরকার, তা হলো বিনয়। দর্শকের সামনে সহজ আর বিনীত হতে পারা উপস্থাপকের একটা বড় গুণ। এতে তিনি জনপ্রিয় হন। এই সহজ হওয়াটা তাঁর জন্য আরও বেশি দরকারি হয়ে পড়ে টেলিভিশনের ক্যামেরার কারণে। ফিল্মের মতো জীবনের প্রতিটি আলাদা মুহূর্তকে ধরে ধরে যত্ন নিয়ে রচনা করে না টিভি ক্যামেরা। এটা ধারণ করে জীবন নামের স্বত্বঃস্ফূর্ত আর প্রবহমান এক গতিময়তাকে। এই চলমান জীবন যত সরল, সুন্দর ও অকৃত্রিম হবে, টিভি ক্যামেরায় ততই তা সহজ, নিটোল আর অন্তরঙ্গ হয়ে ধরা পড়বে।

টিভি ক্যামেরার মতো মানুষের চোখ দুটি একই রকম, তবু তার পেছনে আছে একটা সজীব  মন। তাই আমরা কারও ভেতরে কৃত্রিম ত্রুটিপূর্ণ বা দৃষ্টিকটু কিছু দেখলেও মন দিয়ে সেসবকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করি। ধরা যাক, আমাদের আশপাশের কোনো মানুষের ভেতরে কিছুটা হামবড়া, বিরক্তিকর বা স্কুলমাস্টারসুলভ ভাব আছে, যা খুবই অসহ্য। তার ব্যাপারে আমরা কী করি? আমরা তার ওই খারাপ দিকটা ভুলে তার ভালোটুকু নিয়ে খুশি থাকার চেষ্টা করি। ফলে মানুষের ব্যক্তিত্বের কর্কশ বা বিরক্তিকর ব্যাপারগুলো আমরা অতটা টের পাই না। কিন্তু ক্যামেরার ভেতরে তো ওই ক্ষমাশীল মানবিক হৃদয়টি নেই। ও তো একটা বোকা যন্ত্র, ও যা দেখে হুবহু তা-ই তুলে ধরে। তাই কোনো মানুষের ব্যক্তিত্বে যদি কোনো কৃত্রিমতা, খুঁত বা ত্রুটি থাকে, তবে তা যেমনটি আছে, ঠিক তেমনিভাবে পর্দায় জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে। এ জন্য উপস্থাপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে যা বেশি দরকার, তা হলো স্বাভাবিকতা—ত্রুটি বা যান্ত্রিকতামুক্ত সহজ, সাবলীল অন্তরঙ্গ ব্যক্তিত্ব। এতে কোথাও খুঁত থাকলে তা প্রতিমুহূর্তে জ্ঞাতে-অজান্তে দর্শকদের পীড়িত করবে। ফলে তাঁর পক্ষে দর্শকের কাছে ‘প্রিয়’ হওয়া কঠিন হবে।

আগেই বলেছি, উপস্থাপক তখনই দর্শকপ্রিয় হন, যখন তিনি তাঁর ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতা দিয়ে দর্শককে পরাজিত করতে পারেন এবং সেই সঙ্গে হন বিনয়ী। বহু কিছু দিয়েই তিনি দর্শককে পরাজিত করতে পারেন। ব্যক্তিত্বের বিভা ছাড়াও যেসব ব্যাপারে তাঁকে দর্শকদের ওপরে থাকতে হয়, সেগুলো হলো স্বতঃস্ফূর্ততা, রুচি, বিদ্যাবুদ্ধি ও দীপ্তি, ক্ষিপ্র কৌতুকরস, পরিশীলন, অনুষ্ঠান নির্মাণের কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা, অনুষ্ঠানকে বর্ণাঢ্য করতে পারার প্রতিভা—এমনই অনেক কিছু। যাঁর মধ্যে এই গুণগুলো যত বেশি থাকবে, তিনি হবেন তত ভালো উপস্থাপক। অনেক সময় এ সবের এক-আধটি গুণ কম নিয়েও বা ওই গুণগুলো অনুষ্ঠানের অনুকূল না হওয়া সত্ত্বেও অন্য গুণের সমাহার ঘটিয়ে একই রকম প্রাণবন্ত অনুষ্ঠান করা যায়।

গ্রন্থনা: সজীব মিয়া: প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ। 

প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা তারুণ্য, পঞ্চম সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৫ থেকে নেওয়া।