হিল ট্রেকিং

কথায় আছে, চীনে এসে যারা গ্রেট ওয়ালে গেল না, তারা কখনো চীনেই আসেনি। কিছুদিন আগেই চীনে ছিংমিং ফেস্টিভ্যাল গেল, এই সুযোগে আমরা গিয়েছিলাম বেইজিংয়ের হুয়াইরো জেলার লেক সাইড গ্রেট ওয়ালে। বেশ অল্প সময়ে বেইজিংয়ে বাঙালিদের নিয়ে আমাদের একটি ক্যাম্পেইন গ্রুপ গড়ে উঠেছে, মূল উদ্দেশ্যই এক্সপ্লোরিং। এর আগে বেশ কয়েকবার পাহাড়ে হাইকিং করেছি কিন্তু এবার আমার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছে হিল ট্রেকিংয়ের। প্রথমবারের হওয়ায় অভিজ্ঞতাটা ছিল অনেক বেশি রোমাঞ্চকর, অনেক বেশি উদ্দীপিত এবং একটু ভয়ংকর। গ্রেট ওয়াল দুই ধরনের। একটি উন্মুক্ত সবার জন্য আরেকটি পরিত্যক্ত, যা প্রায় ধ্বংস ও মানবশূন্য।

বেইজিংয়ের হুয়াইরো জেলার লেক সাইড গ্রেট ওয়ালে লেখকসহ বন্ধুরা
বেইজিংয়ের হুয়াইরো জেলার লেক সাইড গ্রেট ওয়ালে লেখকসহ বন্ধুরা


লেক সাইডে ঘুরতে ঘুরতে একটি পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। একটু কাছে গিয়ে দেখি কিছু চায়নিজ নেমে আসছে পাহাড় বেয়ে। তাদের কাছে দড়ি, ব্যাগসহ যাবতীয় ট্রেকিংয়ের ইকুইপমেন্টও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আর উঠতে পারেনি। তাদের নেমে আসা দেখেই হঠাৎ সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা ওপরে যাব। আমাদের ভেতরে কেউই ট্রেকিংয়ে তেমন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন না। সব থেকে বড় ব্যাপার ছিল আমরা ট্রেকিংয়ের কোনো প্রিপারেশনই নিয়ে যাইনি এবং আমাদের কাছে কোনো ইকুইপমেন্টও ছিল না। আমরা যখন ওপরে ওঠার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন চায়নিজগুলো বলছিল, ‘ইটস ভেরি ডিফিকাল্ট’। তখন আমরা তাদের বললাম, ‘ইটস ওকে থ্যাংকস’ আর মনে মনে বলছিলাম, এবার তো উঠেই ছাড়ব। আমরা একবারও কিন্তু ভাবিনি কেমন ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হতে পারি। শুধু ভাবছিলাম ওপরে উঠতেই হবে।

শুরু করলাম গাছের শিকড় ও ডালপালা ধরে ধরে ওপরে ওঠা। শুরুতে একটি গাছ ধরতেই আমার দুই হাতে কাঁটা ঢুকল। তখনো কিন্তু কিছু মনে হয়নি। পাহাড়টি কতটা খাড়া আর লম্বা ছিল, তা ছবি দেখে হয়তো আন্দাজ করা মুশকিল। পাহাড়টি ছোট ছোট নুড়িপাথরে আবৃত ছিল এ জন্য জুতার গ্রিপ পাওয়া যাচ্ছিল না ঠিকমতো। মূলত এটিই আমাদের একটু ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যত ওপরে উঠতে থাকি নুড়িপাথরের পরিমাণটাও তত বাড়তে থাকে। এতে মাটির সঙ্গে পা সঠিকভাবে আঁকড়িয়ে রাখতে পারছিলাম না। মাঝপথ তখনো যাওয়া হয়নি, আমার জুতাটি এমনভাবে স্লিপ কাটল, যে সময়ে আমার বাঁ পাশে কোনো সাপোর্ট ছিল না, কোনো রকমে ডান পাশের ছোট ছোট শিকড় ধরে দাঁড়িয়ে আছি। এমন পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছিল আমার ব্রেন কাজ করা অফ করে দিয়েছে, হার্টবিট ছিল অনেক বেশি ফাস্ট। কী করব, কীভাবে পার হব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে পেছন থেকে তালহা ভাই বেশ মোটিভেট করছিলেন। কারণ, উনার আগের কিছুটা অভিজ্ঞতা ছিল। তিনি ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। হঠাৎ তালহা ভাই পেছন থেকে এসে একটি গাছের ডাল দিয়ে সাপোর্ট দিলেন এবং সেটি ধরে আমি জাস্ট চোখ বন্ধ করে পার হয়েছি।

বেইজিংয়ের হুয়াইরো জেলার লেক সাইড গ্রেট ওয়ালে লেখকসহ বন্ধুরা
বেইজিংয়ের হুয়াইরো জেলার লেক সাইড গ্রেট ওয়ালে লেখকসহ বন্ধুরা


যত ওপরে যাই রাস্তা তত সরু আর কঠিন হতে থাকে। তবে মাঝপথে এসে সবার মনে একটি প্রশ্ন উঠল, আমরা যে ওপরে যাচ্ছি, গ্রেট ওয়াল কি আদৌ আছে ওপরে? হয়তো এত কষ্ট করে না উঠতে হলে এই প্রশ্নটা মনে জাগত না। তবে সিদ্ধান্তে ছিলাম অটল। কারণ, পেছনে যাওয়ারও কোনো উপায় ছিল না তখন। ওপরে যেতে যেতে হঠাৎ সাইহাম ভাই বলে বসলেন, ওপরে ওঠা যতটা কঠিন, নিচে নামা ততটা সহজ। কথাটি শুনে আমি জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে কথাটা চিন্তা করে দেখলাম যে জীবনে বড় হতে গিয়ে সফলতার পেছনে কত–না কষ্টের গল্প থাকে আমাদের, কিন্তু নিচে পড়তে এক সেকেন্ডও লাগে না। জীবনের বাস্তবতার দিকে যদি দেখি তাহলে এমন অসংখ্য উদহারণ পেয়ে যাব।

প্রায় দুই ঘণ্টা এমন যুদ্ধ চলল ওপরে ওঠার। উঠতে উঠতে শেষমেশ দেখা মিলল গ্রেট ওয়ালের। ওয়াল টপকিয়ে ভেতরে ঢুকলাম, ঢুকতেই চোখে পড়ল গ্রেট ওয়ালের ধ্বংসাবশেষ। আশপাশে কোনো লোক নেই, কেউ যায় না সেখানে। তবে দেখতে পেলাম পাহাড় আর মেঘের রাজ্যের এক অপরূপ লীলাভূমি।

সিঁড়ি থেকে ওপরে দেখা যাচ্ছে মিং ডাইনাস্টির ৬০০ বছর পুরোনো ভাঙাচোরা টাওয়ার। শরীর তখন আর চলে না। এত ঠান্ডার মধ্যেও শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে, পুরো গায়ে ধুলাবালি, আমার হাতের বেশ কয়েক জায়গায় ছোট ছোট ক্ষত হয়েছে। তালহা ভাই আর আরেফিন এগিয়ে গেলেন টাওয়ারের দিকে, দেখলাম তন্দ্রা ভাবিও এগোতে থাকলেন এক পা দু পা করে, সাইহাম ভাই বসে গিয়েছেন, তিনি আর যাবেন না। তখন আমি ভাবলাম, এত দূর যখন কষ্ট করে চলেই এসেছি, তখন আরেকটু গিয়ে শেষ সীমানা ছুঁয়ে আসি । টাওয়ারে উঠতেই শোনা যাচ্ছিল মৌমাছির গুনগুনানি আর তীব্র বাতাসের শনশন আওয়াজ। ফাঁকা দেখে একটু ভয়ও হচ্ছিল বটে কিন্তু টাওয়ারের ভেতর দিকে যখন অন্য প্রান্তে পৌঁছালাম, দেখতে পেলাম প্রকৃতির এক বিশেষ সৌন্দর্য, যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এত কষ্ট তখন কিছুই মনে হয় না যখন এমন সুন্দর রূপটির দেখা মেলে। কষ্ট হয়ে যায় সার্থকতা।
বিষয়টি খুবই ছেলেমানুষি ছিল আমাদের। এমন ছেলেমানুষি অনেক বড় দুর্ঘটনার কারণও হতে পারত। কোনো রকম প্রিপারেশন ছাড়াই এমন রিস্ক নিয়েছিলাম ।

চীন থেকে
সাবেক সভাপতি
বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা