চলে যাওয়া মা

২৭–এর মতো বয়সের রুমেল আসলে উষ্কখুষ্ক একটা ছেলে । তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য কী এইটা শুধু রুমেল না সম্ভবত কেউই জানে না। তবে ধারণা করা হয় তাঁর একটা ভয়াবহ ইচ্ছা আছে, সেটা হচ্ছে বাইক কেনা। অন্যেরা বাইক চালায় রুমেল দেখেন। এর ওরটা শখ করে চেয়ে নিয়ে চালান। ছোটবেলায়ই পাশের বাসার মনির কাকার বাইক নিয়ে চালানো শিখে এখন মোটামুটি দক্ষ চালক। বাইক কিনবেন, বাইক যখন চালাবেন শার্টের বোতাম খোলা থাকবে, পুরোদস্তুর ওই সিনেমার জেমস বন্ড সিরিজের ড্যানিয়েল ক্রেগের মতো। দুনিয়াতে ইচ্ছা, অনিচ্ছা, শাসন, ভালোবাসা আর কাছের মানুষ বলতে তাঁর মা। যদিও পৃথিবীতে মা বাদে এত কাছের আর কেউ হয় না। রুমেলের মা-ই রুমেলের কাছে সবকিছু, রুমেলের পৃথিবী। ঢাকা শহরে একটা পাঁচতলা বিল্ডিং থাকার সুবিধার্থে রুমেলকে তেমন চিন্তা করতে হয় না। খুব ভালোভাবেই সংসার চলে যায় রুমেলদের। একদিন রুমেল সাহস করে মাকে বলেই ফেলেন, ‘আমাকে একটা মোটরসাইকেল কিনে দাও। তারপর জীবনে আর কিছুই চাওয়ার নেই।’

মা শুনে নির্বাক, কিছুই বলেননি। ভেতরে–ভেতরে ভাবেন, ছেলেটা চেয়েছে দিতে হবে, আবার ভাবেন, এটা তো সর্বনাশা চাওয়া। তবুও দুই দিন পর রুমেলকে বলেন, ‘আচ্ছা, কমের মধ্যে একটা বাইক কেন।’
এই কথা শুনে রুমেল এলাকায় হইচই ফেলে দেয়। কয়েক দিন পর মায়ের থেকে টাকা নিয়ে বন্ধুদের নিয়ে বাইক কিনে এনে বাসার সামনে রেখে মাকে ডেকে এনে দেখায়। এবং আনন্দে উল্লসিত হয়।
তারপর অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করা গেল। রুমেল বাইক মুছেটুছে রেখে দেয়, বাইকের সামনে বসে থাকেয় কিন্তু বাইক চালায় না। মা ব্যাপারটা লক্ষ করে রুমেলকে বললেন, কী রে, হুন্ডাটা শুধু মুছিস, চালাবি না?’
রুমেল, ‘মা, এইটা নতুন বাইক, তারপর আপনি টাকা দিলেন। প্রথম আপনাকে নিয়ে চালিয়ে এটা উদ্বোধন করব। আমি ভালো চালাই, আপনি পেছনে ওঠেন, এই সামনে গিয়েই চলে আসব। আপনি না উঠলে তো বাইকটা আমার চালানো হবে না।’

রুমেলের মা ভাবলেন, আহা ছেলেটার ভালোবাসার কথা। তিনি না উঠলে রুমেল বাইক চালানো শুরু করতে পারছে না, তাই উঠলেন, উঠে রুমেলকে শক্ত করে চেপে ধরে বসলেন। রুমেল ধীরে, দেখেশুনে বাইক চালাচ্ছে, কারণ পেছনেই বসা পৃথিবীর সব থেকে মূল্যবান মানুষ। রুমেল ওয়্যারলেস থেকে রওনা হয়ে মহাখালী ঘুরতে ইউটার্নের সময় স্পিডে আসা বাস সজোরে ব্রেক করতেও ধাক্কা লাগে রুমেলের বাইকে। ছিটকে যান রুমেলের মা, বাইকসহ রুমেল পল্টি খেতে গিয়ে ডিভাইডারে ধাক্কা খেয়েও দ্রুত উঠে আসে যে মায়ের যেন কিছু না হয়। রুমেল দৌড়ে মায়ের কাছে এসে দেখে, বিভিন্ন জায়গায় কেটে রক্ত বের হচ্ছে, সেন্সলেস। লোকজন ছুটে আসেন, দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। রুমেল মাকে খুব কষ্টে কোলে নিতেই ধীরে ধীরে রুমেলের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। নীল আকাশ যেমন মেঘে ঢেকে যায়, তেমনই ঝাপসা অন্ধকার, রুমেলের কান দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে আর কিছু খেয়াল ছিল না রুমেলের!

মাঝখানে ৭–৮ দিন হারিয়ে গেল, যখন চোখ খুললেন দেখলেন রুমেল হাসপাতালে এবং পরিবেশ দেখে বুঝলেন ইমারজেন্সিতে। কথা বলতে পারলেন না, নড়তেও পারলেন না, শুধু চোখ দিয়ে দেখে যাচ্ছেন। এভাবে মাসখানেক কেটে গেল। মোটামুটি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে জানলেন, বাইক থেকে ছিটকে পড়ে হাসপাতালে নিতেই মারা গেছেন মা। মা কোথায় সমাধিস্থ হয়েছেন, সেখানে গেল, দেখেই কান্নাকাটি করল, অনুশোচনায় ভুগতে শুরু করল রুমেল।
সেখান থেকে ফিরে রুমেল আর কোনো দিন কথা বলেনি, ভেতরে–ভেতরে প্রচণ্ড অনুশোচনা নিয়ে বেঁচে থাকে রুমেল, যে তাঁর জন্য মা মারা গেছেন। ক্ষমাহীন অপরাধবোধ নিয়ে পাগলপ্রায় দিন কাটায় রুমেল।
অসহায় রুমেল পাথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন বাসার সামনে রাখা অ্যাকসিডেন্টে ভেঙে যাওয়া বাইকটার দিকে, টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে চোখ দিয়ে! মা নেই, চলে গেছেন।

ইন্দিরা রোড, ঢাকা