কারিকা

তখন সন্ধ্যা। সারা বিকেল ধরে মেঘেদের তর্জন-গর্জন-হুমকির পর বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির গতি ক্রমশ বাড়ছে, তাতে আমার সঙ্গের সরঞ্জাম নিয়ে আর বেশি দূর এগোতে পারব না। সরঞ্জাম বলতে আমার ক্যামেরাটা, পিঠের ব্যাগে ঠাসা কিছু কাগজের ফাইল, আর…সবচেয়ে জরুরি যেটা সেটাই খুইয়ে এসেছি কোথাও, ছাতা। এক এনজিওর হয়ে বেদে সম্প্রদায়ের ডেটা কালেকশনের কাজে বেরিয়েছিলাম। বছরের নির্দিষ্ট একটা সময়ে বেদেরা এই নদীর ধারের বিশাল মালিকানাবিহীন জমিতে এসে অস্থায়ী বাসা বাঁধে।

পলিথিন আর চট দিয়ে তৈরি অস্থায়ী তাঁবুর সারিগুলোর মধ্য দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে আর বৃষ্টির তীব্রতাকে উপেক্ষা করা গেল না। বাধ্য হয়ে পাশের একটা তাঁবুর কিছু অংশ ফাঁকা পেয়ে কাছে গিয়ে ইশারায় আশ্রয় চাইলাম। ভেতর থেকে একটা শীর্ণ নারীর হাত পলিথিনের বেষ্টনীকে আরও খানিকটা ফাঁকা করে দিল, ঢুকে পড়লাম। তাঁবুর ছাদে বৃষ্টির ফোঁটাদের সজোরে আঘাতের শব্দে কথোপকথনের কোনো সুযোগ ছিল না।

তেলকুপির টিমটিমে আলোয় নারীটিকে যেটুকু দেখলাম তাতে বছর তিরিশের বলে মনে হলো, যদিও এদের বয়স আন্দাজ করা কঠিন কাজ। কুপিটির কাছে গিয়ে পিঠের ব্যাগটা নামিয়ে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁবুর ভেতর বিচ্ছিন্নভাবে থাকা দুটি শিশুকে আবিষ্কার করলাম। বছর তিনেকের ছেলেটি আমার দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে এসে হাত পাতল, মুখ দিয়ে কিছু বলল, কিন্তু কী বলল, তা বোঝা গেল না। আমি প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ছেলেটির চেহারা দেখে ক্ষুধার্ত বলেই মনে হলো। ডেটা কালেকশনে আসার সময় সঙ্গে কিছু বিস্কুট এনেছিলাম, তার কিছুটা অবশিষ্ট আছে স্মরণ হওয়ায় পিঠের ব্যাগের সাইড পকেট হাতড়ে বিস্কুটের ঠোঙাটা বের করে শিশুটির হাতে দিলাম। চোখের পলকে মেয়ে শিশুটি এসে কাড়াকাড়ি করে তার ভাগ বুঝে নিল। ছেলেটিও পরপর গোগ্রাসে দুটি বিস্কুট খেয়ে ঠোঙা থেকে শেষ বিস্কুটটি তুলে নিল।

একবার ওটাতে কামড় দিতে গিয়ে থেমে সেই নারীটির দিকে তাকাল। মুখ দিয়ে কিছু বলল, তার শব্দ বৃষ্টির কারণে না শোনা গেলেও মুখের নড়া দেখে বুঝে নিলাম “মা” বলে ডাকল তাকে। ছেলেটি নারীটির দিকে অগ্রসর হতে হতে নিজের অজান্তেই হাতে ধরা বিস্কুটে গোটা দুই কামড় বসিয়ে দিল, বাকি অর্ধেকটা নারীটির দিকে এগিয়ে দিল। আমি সম্মোহিতের মতো শুধু দেখছিলাম, তেলকুপির টিমটিমে আলোয় মানুষের মুখের অভিব্যক্তি অত স্পষ্ট দেখা যায়, আমার ধারণা ছিল না। মুহূর্তেই নারীটির মুখে যে হাসি ফুটে উঠল, সেটার আলাদা একটা ঔজ্জ্বল্য ছিল বোধ হয়, তা না হলে আমি অতটাও স্পষ্ট দেখতে পেতাম না।

মা শিশুটির কপালে একটা চুমু একে বিস্কুটের অবশিষ্টটুকুও তার মুখেই পুরে দিল। শিশুটি পরম আনন্দে মাকে আলিঙ্গন করল। তেলকুপির আলোয় আমি দেখলাম, শিশুটির অলক্ষ্যে ক্ষুধার জ্বালায় ক্ষণিকের জন্য বিকৃত নারীর মুখটি সন্তানের মনোযোগপ্রাপ্ত হয়েই মায়ের ভূমিকায় বারবার হাসিমুখে অবতীর্ণ হচ্ছিল।

বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়