মায়ের মুখে হাসি

কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় মায়ের গুণগান গেয়েছেন। পৃথিবীর সব মায়েরা হয়তো এমনি। কিন্তু আমি আজ সব মায়েদের গল্প করব না। করব শুধু আমার মায়ের গল্প।

আমার বাবা যখন মারা যান, তখন আমরা ভাইবোনেরা ছোট ছিলাম। ছয় ভাইবোনের মধ্যে বড় বোন পড়ত একাদশ শ্রেণিতে। ছোট দুজনের মধ্যে একজন পড়ত ক্লাস ওয়ান ও অপরজন তখন পর্যন্ত পড়াশোনার দুনিয়ায় প্রবেশ করেনি। ভাইদের মধ্যে বড়জন পড়ত ক্লাস এইটে আর ছোটজন ক্লাস ফোরে। আমি তখন ছিলাম ক্লাস সিক্সে। আমার মা তখন এতগুলো ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে সদ্য বিধবা।

মায়ের পড়াশোনা তেমন নেই। তাই চাকরি করার কোনো সম্ভাবনা ছিল না তখন। পরিবার পরিচালনার জন্য উপার্জনের কোনো ক্ষেত্র বাবা রেখে যাননি। বুঝতেই পারছেন সেই সময়ে আমার পরিবারের অবস্থা।
বাবা মারা যাওয়ার পর পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সবাই আমার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই পরিবারটি নিয়ে কীভাবে পথ চলবেন?’। মায়ের উত্তর ছিল, ‘সৃষ্টিকর্তা যেহেতু পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে তাঁর কাছে নিয়ে গেছেন, সেহেতু তিনিই আমাদের পথ চালাবেন।’

১১ বছর গত হয়ে গেছে বাবাকে ছাড়া। আমরা দুই ভাই বর্তমানে দেশের স্বনামধন্য একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি। পরিবারের এই পর্যন্ত আসতে অক্সিজেন হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন আমার মা। এসএসসি পরীক্ষার পর অনেকেই বিদেশে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে মায়ের ভাষ্য ছিল, না! আমি আমার সন্তানদের পড়াশোনা করাব।

গত ১১ বছরের প্রত্যেকটা দিন মা আমাদের জন্য তাঁর সুখ বিসর্জন দিয়ে আসছেন। নিজের সুখ-দুঃখ, শখ, ভালোলাগা-মন্দলাগা সবকিছুই আমাদের ঘিরে। মাঝেমধ্যেই ওনাকে বলি, মা আপনি নিজের জন্য ভালো জামাকাপড় ক্রয় করেন, কোথাও বেড়াতে যান। আজকাল ওনার শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না, বলি ভালো কোনো ডাক্তারের কাছে যান। ওনার ভাষ্য, ডাক্তারের কাছে গেলে অনেক খরচ, তখন আবার তোদের পড়াশোনার খরচ দিতে কষ্ট হয়ে যাবে। মা বলেন, তোদের সুখই আমার সুখ, তোরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকব।

একটা ঘটনা বলি। কয়েক বছর আগে রোজার ঈদ ঘনিয়ে আসছে। পরিবারের কারও জন্যই কোনো কিছু কেনা হয়নি। মায়ের হাতে টাকা ছিল না তখন। আমাদেরও মন খারাপ। তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, পুরোনো পাঞ্জাবি দিয়েই এবারের ঈদের নামাজ পড়ব। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছিল, ছোট দুই বোনের জন্য। এই দুজন বাবার আদর তেমন একটা পায়নি। অন্তত এই দুজনের জন্য হলেও নতুন জামা প্রয়োজন। আমাদের মন খারাপ দেখে মায়ের মনেও শান্তি ছিল না। তাই ঈদের আগের দিন কোথা থেকে যেন মা টাকা জোগাড় করে আনেন। বড় ভাইয়ের হাতে দিয়ে বললেন, ‘দুই বোনের জন্য যা কিছু লাগে কিনে নিয়ে আয়, আর তোদের তিন ভাইয়ের জন্য তিনটা পাঞ্জাবি। সঙ্গে ঈদের জন্যও বাজার করে নিয়ে আসিস।’

এই হচ্ছে আমার মা। যিনি আছেন বলেই আমরা এখনো পৃথিবীতে ভালোভাবে বেঁচে আছি। অনেক বড় হতে চাই আমি। বাংলাদেশের সফল ব্যক্তিদের একজন। যাঁকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় আর্টিকেল লেখা হবে, ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি হবে। শুধু আমার মায়ের জন্য, মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আমি এই পৃথিবীতে সফলকাম হতে চাই।

সহসভাপতি, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা