মায়েদের পাশে বন্ধুরা

মায়েদের পাশে বন্ধুরা।
মায়েদের পাশে বন্ধুরা।

গতকাল ১৯ মে ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার বন্ধুরা উত্তরার একটি বৃদ্ধ নিবাসে সময় কাটান। বন্ধুরা তাদের আয়োজনে বৃদ্ধাদের ইফতার করান। ১৮ মে শনিবার রাত কিছুটা নির্ঘুম কেটেছে তাঁদের। রাত পোহালেই একটি মহৎ উদ্যোগের সঙ্গী হবেন তাঁরা। সকাল সকাল জাগতে হবে, তারপর...চিন্তায় ঘুম আসে আর যায়। ১৯ মার্চ ফিরোজ আলমের সঙ্গে দেখা হলেই জান্নাতুল ফেরদৌস লিজা বলেন, ‘আমি না সারা রাত ঘুমোতে পারিনি। ভয়ে ছিলাম যদি বাস মিস করি!’ এরপর একে একে প্রিয়াঙ্কা, রামিম, নাওমি, তৌহিদ, আনিস, হৃদয় ও রহাত বললেন তাঁদের কথা। সবার খবর একই।

মায়েদের পাশে বন্ধুরা।
মায়েদের পাশে বন্ধুরা।


ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর, ঝিগাতলা, ধানমন্ডি, মিরপুর ও পল্লবী থেকে বাসযোগে দশ বন্ধু উত্তরা আব্দুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডে নামলেন। বন্ধুরা জড়ো হয়ে তাঁদের প্রস্তুতির কথা বলছিলেন। গন্তব্য মৈনারটেক, উত্তরখান, উত্তরা ‘আপন নিবাস’ বৃদ্ধাশ্রমে।
শহরের মধ্যেও যেন কিছুটা গ্রাম। আব্দুল্লাহপুর থেকে যাত্রা করে অটো যে স্থানে নামাল, সেখানে সবুজে ভরা। আম ও কাঁঠালগাছে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের প্রকৃত রূপ দেখা গেল। চিকন একটি রাস্তার দুর্বা মাড়িয়ে বন্ধুরা পৌঁছাল আপন নিবাসে। দোতলা একটি বিল্ডিং, রংহীন দেয়ালের সাইনবোর্ডে লেখা কবি শেখ সাদির একটি বাণী, ‘তসবিহ এবং সেজদা দেখে খোদ এলাহী ভুলবে না, মানব সেবার পুঞ্জি ছাড়া স্বর্গ দুয়ার খুলবে না।’
শেখ সাদির বাণী পড়তে পড়তে কলিংবেল চাপা হলো। বাড়ির ভেতর থেকে মাঝবয়সী একজন নারী দরজা খুললেন। নিয়ে গেলেন বেশ কিছু বৃদ্ধার কাছে। সুবাসিনী নামের বয়স্ক নারী অস্পষ্ট চোখে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কারা? বৃদ্ধাশ্রমের সেবিকা একজন বললেন, ‘তোমার নাতি-নাতনিরা এসেছে। সারা দিন তোমাদের সঙ্গে থাকবে। গল্প করবে।’ বিছানায় শোয়াবসা কয়েকজনের মুখে হাসি, কারও চোখে হতাশার ছাপ ফুটে উঠল।
বন্ধু হৃদয় গল্পে মেতে উঠলেন শরবানুর সঙ্গে। চালসে দৃষ্টিতে দেখেন তিনি, কানে বেশ কম শোনেন। হৃদয় বলল, তুমি আমার দাদির মতোই দেখতে। কথাটি বুঝতে বেশ সময় নিয়েছেন শরবানু দাদি। অন্য এক বন্ধু দাদিমার পাশে গেলে মুখে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘কেডা, সাত্তার?’ হয়তো একদিন সাত্তার তাঁর কাছের কেউ ছিলেন।

মায়েদের পাশে বন্ধুরা।
মায়েদের পাশে বন্ধুরা।


বন্ধু প্রিয়াঙ্কা গিয়ে কথা জমালেন সালেহা আক্তারের সঙ্গে। প্রিয়াঙ্কার নাম শুনে প্রবীণ সালেহা আক্তার বললেন, ‘তুমি নায়িকা প্রিয়াঙ্কার চেয়েও সুন্দর।’ প্রিয়াঙ্কাকে কাছে নিলেন তিনি। প্রিয়াঙ্কাও দাদিমাকে জড়িয়ে পার করলেন বেশ কিছু সময়।
এরই মধ্যে সুভাষিণী নামের একজন গেয়ে ওঠেন, ‘আকাশেতে উড়িল পাখি, আরে ও কাজলবরণ দুটি আঁখি’। মানসিক ভারসাম্যহীন সুভাষিণী। কীভাবে এ দেশে এসেছেন, তা জানেন। স্বামী শ্রীবাস কুমার মজুমদারের নাম স্পষ্ট মনে আছে তাঁর। কথা বলতে বলতে এক প্রবীণ নারীকে খুব আপন মনে হয় বন্ধু নওমির। নিজ হাতের একটি চুড়ি খুলে পরিয়ে দেন তাঁর হাতে। খুশিতে কাছে টেনে নেন বন্ধুকে। তাঁকে ছেড়ে না যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমে যাঁদের স্থান হয়েছে, সবাই অসহায় নারী। সবাই যে বৃদ্ধ, তা নয়। শিশু ও কিশোরী মেয়েরও একমাত্র আশ্রয়স্থল এই আপন নিবাস। জন্মান্ধ পাখির বয়স ১৪। কেউ নেই তার। আপন নিবাসই তার বাড়ি। ৭ বছরের জান্নাতির মা আত্মহত্যা করেছে, তারও স্থান হয়েছে এই আশ্রমে। এখানে আছেন সবচেয়ে বৃদ্ধ বয়সী জহুরা বেগম। আছেন রাস্তায় পড়ে থাকা মানসিক ভারসাম্যহীন, বোবা, অন্ধ, অচল,অবহেলিত নারীরা। সৈয়দা সেলিনা শেলী তাঁদের শেষ আশ্রয়স্থল।

মায়েদের পাশে বন্ধুরা।
মায়েদের পাশে বন্ধুরা।


সাবেক এনজিও কর্মী এই নারী আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক। নিতান্ত নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মহৎ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান তিনি। ২০১০ সালের ৮ মার্চে বৃদ্ধাশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন। দোতলা একটি ভাড়া বাসায় অনেকটা কষ্ট করেই চলছে সেবা কার্যক্রম। বর্তমানে ৫০ জন সদস্যের বৃদ্ধাশ্রমটি চালাতে অনেকটা হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। আশ্রমের সদস্যদের সবাইকে মায়ের মতোই দেখে রাখেন শেলী। স্বেচ্ছাসেবক আছেন ১২ জন। অসুস্থ মায়েদের জন্য কখনও নির্ঘুম রাত পার করতে হয় সৈয়দা সেলিনা শেলীকে, প্রতিটি মায়ের চলে যাওয়াতে তিনি কেঁদেছেন অঝরে। শেলীর মনে দীর্ঘশ্বাস জমেছে, বয়সের ভারে তিনিও অদৃশ্য সময়ের ডাক অনুভব করেন। তখন ধূসর আকাশে অসহায় মায়েদের ছবি দেখতে পান।
বন্ধুদের সঙ্গে এই আয়োজেনে অংশ নেন ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সভাপতি জান্নাতুল বাকের। তিনি বৃদ্ধা মায়েদের জন্য প্রয়োজনীয় কাপড়, বালিশের কভার, মশারি ইত্যাদি প্রতি বছর প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন।