বান্দরবান বন্ধুসভার বন্ধু মং মং সোর চীন জয়ের গল্প

বন্ধু মং মং সো
বন্ধু মং মং সো


অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি বন্ধুদের সফলতা আমাকে বেশ নাড়া দেয়। আমি বেশ কিছু বন্ধুর ছোট-বড় সফলতার সাক্ষী হয়েছি। অভিজ্ঞতাগুলো এমন যে তারা যখন নিজের সফলতার গল্প বলে যাচ্ছিল, আমি এদিকে চোখের কোনায় জমতে থাকা জলগুলো লুকাচ্ছি। আবেগ সামলাচ্ছি। তাদের মধ্যে আজকে এমন একজনকে নিয়ে লিখতে বসেছি যে চিত্রশিল্পী হিসেবে সারা পৃথিবী থেকে চিত্রকলার সব পুরস্কার-টুরস্কার আর সম্মান নিয়ে হাজির হলেও দেশের মানুষ খুব একটা তার খবর জানে না।

চিত্রকলায় বন্ধু মং মং সোর চীন জয়ের গল্প
চিত্রকলায় বন্ধু মং মং সোর চীন জয়ের গল্প


মং মং সো বান্দরবান বন্ধুসভার সাবেক সভাপতি । তার শৈল্পিক যাত্রাটা সমুদ্র উপকূল থেকেই শুরু। কক্সবাজারের মহেশখালীতে জন্ম নেওয়া মং মং সোর ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলারের কারিগর হবে। তার ইচ্ছা ছিল এলাকার সবচেয়ে সুন্দর ট্রলারগুলো সে নিজের হাতে বানাবে। মজার বিষয় হলো, মং মং সো সাত বছর ধরে দেশের বাইরে বসে সেই ভিন্ন পরিবেশে থেকেও তার আঁকাআঁকির বিষয় নির্ধারণ করেছে মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলার, মাঝিমাল্লা, মহাজন, আড়তদার, কুলি-মজুর, নৌকার কারিগর—এঁরাই। আমি গল্পচ্ছলে মং মং সোকে বললাম, ‘তুমি তো দেখি আজও নৌকার কারিগর হওয়ার ভূত মাথা থেকে ফেলতে পারোনি। রং-তুলি দিয়েই নৌকা বানিয়ে যাচ্ছ। ঘটনা কী?’

চিত্রকলায় বন্ধু মং মং সোর চীন জয়ের গল্প
চিত্রকলায় বন্ধু মং মং সোর চীন জয়ের গল্প


মং মং সো বলল, ‘বাহ! তাই তো! দারুণ মিলিয়ে দিয়েছ। এভাবে ভাবিনি কখনো। যদিও শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন আমার অন্তহীন। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকাআঁকির সঙ্গে পরিচয় আর বেড়ে ওঠা। বাবাও আঁকাআঁকি করতেন। আঁকাআঁকিটা তাঁর পেশা ছিল। অতএব, অনুপ্রেরণাটা পারিবারিক সূত্রেই পাওয়া বলা যায়। সেই সূত্র ধরেই আজ পর্যন্ত আমার এই পথচলা। আমার আঁকাআঁকির একটা প্রধান বিষয় হলো সাগর, নদী, নৌকা আর সাগরপাড়ের জীবন। আমার কাজে বেশির ভাগ সময় এই বিষয়টা চলে আসে। এর পেছনে গল্পটা হলো, সম্ভবত আমার জন্ম আর শৈশবটা সাগরকে ঘিরে কেটেছে। তাই হয়তো আমার শিল্পীমন স্মৃতিগুলোকে একটা শৈল্পিক রূপ দিতে চাইছে।

চিত্রকলায় বন্ধু মং মং সোর চীন জয়ের গল্প
চিত্রকলায় বন্ধু মং মং সোর চীন জয়ের গল্প


এই অঞ্চলের সঙ্গে আমার আজন্ম সম্পর্ক। বর্তমানে “দ্য ফিশারবোট অ্যান্ড লাইফ” শিরোনামে আমার গবেষণা ও আঁকাআঁকি চলছে। শৈশবে আমি কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপের বালুচরে আঙুল দিয়ে দাগ কেটে কেটে ইচ্ছেমতো আঁকিবুঁকি করেছি। জানতাম না, ধীরে ধীরে সাগরতীরে আঁকা সেই দাগগুলো এত শক্ত করে বসে যাবে আমার মনে।’

চিত্রকলায় বন্ধু মং মং সোর চীন জয়ের গল্প
চিত্রকলায় বন্ধু মং মং সোর চীন জয়ের গল্প


সম্প্রতি চীনের কুনমিংয়ের ইউনান আর্টস ইউনিভার্সিটি গ্যালারিতে মং মং সোর ‘দ্য সংস অব ফিশারম্যান’ শিরোনামে একক চিত্রকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। আমি প্রথম দিন থেকেই লক্ষ করছি বিশাল এই গ্যালারিজুড়ে চীনারা মং মং সোর আঁকা বাংলাদেশ দেখছে। অবাক হয়ে আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা জলরঙে আঁকা নৌকা দেখছে। ঘাটে ফেরা নৌকায় মহাজন, আড়তদার, কুলি-মজুরদের ব্যস্ততা দেখছে।

চিত্রকলায় বন্ধু মং মং সোর চীন জয়ের গল্প
চিত্রকলায় বন্ধু মং মং সোর চীন জয়ের গল্প


একটা কক্ষে মং মং সোর করা নানান রঙের নৌকার ভাস্কর্য দেখছে। তারপরই দর্শনার্থীরা ঢুকে পড়ছে ইনস্টলেশন আর্ট দেখতে। সব শেষে তারা চলে যাচ্ছে গ্যালারির অন্ধকার একটা কক্ষে যেখানে বাংলাদেশ থেকে ক্যামেরায় ধারণ করে আনা মাঝি-মাল্লাদের জীবনের ওপর ছোট্ট একটা প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে।

চিত্রকলায় বন্ধু মং মং সোর চীন জয়ের গল্প
চিত্রকলায় বন্ধু মং মং সোর চীন জয়ের গল্প


শিল্পী মং মং সো শেষ দিন সন্ধ্যায় পুরো প্রদর্শনীর আয়োজন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলে, ‘এটা আমার  একক প্রদর্শনী হলেও আমি একা কখনোই এই কাজটা একা শেষ করতে পারতাম না, যদি আমার পাশে আমার বন্ধুরা না থাকত। আমি জলরঙে আঁকি। এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় একটা মাধ্যম। এটা আমি একা স্বচ্ছন্দে করি। কিন্তু অন্য মাধ্যমও আমি প্রদর্শনীতে যুক্ত করেছি, তার প্রতিটিতে রয়েছে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধুদের রাত জাগা খাটুনি আর মেধা বিনিময়। যেমন, ইনস্টলেশন আর্টে আমি আমাদের বিখ্যাত রিয়া আপুর (ইফাত রেজুওয়ানা রিয়া) সহযোগিতা পেয়েছি; যিনি এই মাধ্যমে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের জাতীয় পুরস্কার পাওয়া শিল্পী। প্রামাণ্যচিত্র তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতা নোমান রবিন; যিনি শেষ দুই বছরে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে বিশ্বে বেশ নাম কামিয়ে ফেলেছেন। আর আমার বাংলাদেশের শিক্ষক অলক রায়, ইউনান আর্টস ইউনিভার্সিটির শিক্ষক চান লিও স্যারসহ যেসব শিক্ষকের সহযোগিতা ও শিক্ষা পেয়েছি, এই ভালোবাসাগুলো আমি অস্বীকার করি কী করে? একক প্রদর্শনী হলেও আমি আমার বন্ধু ও শিক্ষকদের সব অবদানকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করছি, ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।’

চিত্রকলায় বন্ধু মং মং সোর চীন জয়ের গল্প
চিত্রকলায় বন্ধু মং মং সোর চীন জয়ের গল্প


আমি বিশ্বাস করি, মং মং সোর মতোই আমাদের বন্ধুরা এক একজন নিজের নিজের ক্ষেত্র থেকে বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেবে। চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, বিজ্ঞান, নেতৃত্ব—সব জায়গায় আমাদের বন্ধুসভার বন্ধুরা বিশ্ব মাতিয়ে তুলবে একদিন। আর এসব ঘটনা দেখে আমি যদি মাঝেমধ্যে লুকিয়ে আবেগ সামলাই, চোখের পানিটানি মুছি, এতে কারও কোনো প্রশ্ন থাকবে কি?