এই দৃশ্যগুলো অপার্থিব


প্রথম আলো বন্ধুসভার সঙ্গে প্রথম শীতবস্ত্র দিতে গিয়েছিলাম যমুনাপাড়ের গুচ্ছ গ্রামগুলোতে। অনেক দিন আগের কথা। মনে পড়ে, হাড় কাঁপানো শীতে কাঁপছিল সেখানকার মানুষেরা। নদীর তীব্র বাতাস নগ্ন কুটিরে ঢুকে কামড়ে দিচ্ছে শিশু–বৃদ্ধদের শরীর। যখন আমরা ওদের হাতে গরম কাপড় তুলে দিলাম, ওরা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।

আমি ব্যক্তিগতভাবে সেই দৃশ্যগুলো এখনো মনের দেয়ালে বাঁধাই করা ছবির মতো টাঙিয়ে রেখেছি। এই ছবিগুলো আমি দেখতে পাই। দেখি, যখন খুব মন খারাপ থাকে অস্থির সময়ে, মানুষের নির্বিকার ভেসে যাওয়া দেখি, তখন ভেতরের ভালো লাগার প্রয়োজনে এই দৃশ্যগুলো দেখার চেষ্টা করি।
এই তো, আমার বন্ধুরা রঙিন জামা দিচ্ছে। প্রতিদিন কত ছবি, কত উচ্ছল হাসিমুখ দেখছি। কত না–বলা কথা ফুটে উঠছে ওদের চোখেমুখে।
সেই কিশোরবেলার কথা মনে পড়ছে। বাবা ঈদের আগে রঙিন কাপড়ের জামা চোখের সামনে মেলে ধরতেন। আমি আনন্দে হাততালি দিয়ে ছোঁ মেরে জামাটি হাতে নিতাম।
বাহ!
কী সুন্দর!
নতুন জামা পরে ঈদ উদ্‌যাপন। বাঁধভাঙা খুশির সীমা থাকত না। নতুন জামা নেই, ঈদটাই যেন মাটি। বিবর্ণ হয়ে যেত সব আয়োজন।
আমাদের আনন্দ ঈদ, আর ঈদ মানেই একটা নতুন জামা।  নতুন কাপড়ের ঘ্রাণ।
তখন ভাবিনি; আমার মতো কত শিশু-কিশোর পথেঘাটে বড় হয়েছে। তারা জানতে পারেনি, ঈদ মানে জামা। নতুন সুতার ঘ্রাণ নিয়ে, নতুন সুতার নরম সেলাইয়ের আতরমাখা একটি রঙিন দিন।
এখনো পারে না জানতে! অনেক শিশু-কিশোর ঈদ বলতে কেবল এক বাটি মিষ্টি সেমাই খাওয়ার আনন্দ পেতে অপেক্ষায় থাকে। শিশু-কিশোরদের নগ্ন শরীরে নেই রঙিন জামা। পেটের কাছে ক্ষুধার ক্ষীণ প্রার্থনা তাই বুকের সমস্তটা দখল করে রাখে।
সারা দেশে বন্ধুদের দেওয়া রঙিন জামা এখন ওদের। ওরা জামা হাতে পেয়ে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। আমার? আমার!
কী বিস্ময়াতীত অস্ফুট কণ্ঠস্বর ওদের।
আমার!
আকাশ সমান চোখ নিয়ে দেখা। ওদের শুভ্র মেঘের মতো সাদা চোখের ভেতর রঙিন জামাটা যেন একটি বর্ণিল ঘুড়ি। দুই হাত মেলে ধরে উড়িয়ে দিচ্ছে। দেখছে! কত রং! চমৎকার কারুকার্য। আর বন্ধুরা দেখছে ওদেরকে। আহ্!
জীবনের আজন্ম দুঃখকষ্টকে অতিক্রম করে এই শিশুরা একগুচ্ছ রং ছড়িয়ে নিচ্ছে নিজের শীর্ণ দেহটার সঙ্গে । বলছে, আমার! এই জামাটি আমার!
কত হাসিমুখ, কত আনন্দ। আমরা আমাদের কাছে এই আনন্দ মুখের ছবিগুলো মনের ক্যামেরা দিয়ে পরম যত্নে তুলে রাখছি। ধরে রাখছি। কখনো নিজেরা অসুখে-বিসুখে বিপর্যস্ত হলে, ওদের ওই মুখগুলোর ছবি দেখে একটু ভালো থাকার শান্তি নেব।
বন্ধুদের এই প্রয়াস চিরজীবী হোক। মনের ক্যামেরায় বারবার তোলা হোক এই অপার্থিব আনন্দ অনুভূতির দৃশ্যাবলি।

সহকারী অধ্যাপক, পাবনা সরকারি মহিলা কলেজ
উপদেষ্টা, পাবনা বন্ধুসভা।