চীনকে চিনি-১

১৫তম মাইউয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল
১৫তম মাইউয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল


অনেক দিন ধরে ইচ্ছে হচ্ছিল বন্ধুদের সঙ্গে একফাঁকে চলচ্চিত্রের আড্ডা জমিয়ে দিই। দেশের বাইরে থাকায় এটা সম্ভব হচ্ছে না। পেটে কথাগুলো জমে গেলেও তো একটা চাপ। ভাবলাম লিখে ফেলা যায়। আজকে সেই গল্পই হবে। চলচ্চিত্রের ছাত্র হিসেবে এটা আমি স্বচ্ছন্দেই করতে পারি।

কদিন আগে আমাদের ইউনিভার্সিটিতে (ইউনান আর্টস ইউনিভার্সিটি) চলচ্চিত্র বিভাগের ১৫তম মাইউয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল শুরু হয়েছে। পনেরো বছর ধরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ছাত্ররা শিক্ষাজীবনের শেষে এসে তাঁদের তৈরি করা সবচেয়ে ভালো কাজটা উৎসবের জন্য জমা দেন। এর মধ্য থেকে বাছাই করা ফিচার ফিল্ম, তথ্যচিত্র ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানগুলো প্রতিদিন দর্শকের জন্য উন্মুক্ত প্রদর্শন করা হয়। আমি প্রতিদিন ঘুরে ঘুরে দেখি। তাঁদের আলোচনা শুনি। হাততালি দিই। বেশি ভালো লাগলে নতুন নির্মাতাকে গিয়ে একটা ফুলের তোড়া তুলে দিয়ে আসি। এই হলো আমাদের পরবর্তী চলচ্চিত্রযাত্রীদের পিঠ চাপড়ে দেওয়ার ঢং।

চলচ্চিত্রের ছাত্রদের জন্য চলচ্চিত্র উৎসবে দর্শক বা প্রতিযোগী হিসেবে অংশগ্রহণ করাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। চলচ্চিত্র যেহেতু কবিতা বা চিত্রকর্ম না যে একা একা ভাবনাগুলোকে কলম বা কালি দিয়ে এঁকে মানুষের সামনে তুলে ধরলেই হয়ে গেল, এটা যেহেতু অনেক শিল্পের একটা সম্মিলিত মাধ্যম, সেহেতু এর সঙ্গে একঝাঁক সৃষ্টিশীল মানুষের ঘামঝরানো পরিশ্রম আর মেধার পরিপূর্ণ মিলন না থাকলে ঠিক চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে না। তাই প্রয়োজন কোথায় এই মেধা ছড়ানো হচ্ছে বা কোথায় চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্ট মানুষেরা বৈঠক পাকাচ্ছে, চলচ্চিত্রের আড্ডা ও আলোচনা হচ্ছে তা অনুসরণ করা। এ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র উৎসবগুলো সবচেয়ে উপকারী জায়গা।

একসময় চায়নার অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রগুলো বাংলাদেশের দর্শক খুব পছন্দ করত। আমাদের ছোটবেলায় ব্রুস লি, জেকি চ্যান, জেট লি এঁরা খুব পরিচিত নাম। চাইনিজ এই চলচ্চিত্রগুলো বেশির ভাগ সময় চাইনিজ মিথের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। যেমন ড্রাগন ফেস্টিভ্যাল, মাংকি কিং বা বানর রাজা, ঘুমন্ত রূপসীর পর্বত—এসব খুব পরিচিত গল্প। চীনের মানুষ এসব মিথকে বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধার পর্যায়ে নিয়ে গেছে বলে তাদের তৈরি করা গল্পগুলো মানুষ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে চলচ্চিত্রের গল্পে পরিবর্তন এলেও চীনের টেলিভিশন নাটকগুলোতে এখনো প্রচুর মিথলজিক্যাল গল্প ধারণ করা হয় এবং নির্মাণকৌশল উন্নত হওয়ায় এ দেশে এগুলোর দর্শকসংখ্যা প্রচুর।

আড্ডা হচ্ছিল মাইউয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নিয়ে। গত দুটো আয়োজন আমি নিজের চোখে দেখেছি। আয়োজন আড়ম্বরপূর্ণ।

আমি চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোং চিয়ের কাছে গিয়ে বললাম, ‘আমরা কিন্তু চাইলেই আমাদের এই মাইউয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালকে আন্তর্জাতিক উৎসবে রূপ দিতে পারি। প্রথমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে চলচ্চিত্র আহ্বান করে কাজ শুরু করা যায়।’ তিনি আমার কথায় বেশ আনন্দিত হলেন। আমার ওপর বিশ্বাস রেখে বললেন, ‘এই উৎসব আয়োজন করার দায়িত্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তোমার। কারণ, তুমি ভালো করেই জানো চীনে সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা কেমন। আর আমরা এসবে অনভ্যস্থ হয়ে যাওয়াতে এখন সাহসও করতে পারি না আন্তর্জাতিক কোনো আয়োজনের। এ ক্ষেত্রে তোমাদের মতো তরুণদেরকেই সামনে থেকে কাজ করতে হবে।’

আমি সেদিন খুব খুশি হয়ে তাঁর অফিস থেকে বের হয়েছিলাম। কোনো কিছুর আয়োজন করা আমার পুরোনো অভ্যাস। দেশে বন্ধুসভা করে এসব অভিজ্ঞতার ঝুলি বড় হয়ে গেছে। আমি অঙ্ক কষে ফেলেছি, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজনে কতটুকু সতর্ক থাকতে হবে এবং কতটুকু গোছানো হতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগোচ্ছে। হাতে আছে সময় আরও অন্তত ১০ মাস।

অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের তরুণ চলচ্চিত্রনির্মাতারা চীনে তাঁদের কাজ নিয়ে আসবেন। দক্ষতা দেখাবেন। পুরস্কার হাতে নিয়ে তাঁদের গল্প শোনাবেন—এই দৃশ্য দেখার জন্য আমি বেশ মুখিয়ে আছি।

অতএব এ বছরে আমাকে বেশ চাপ নিতে হবে বুঝে গিয়েছি।

চলচ্চিত্র উৎসবের আড্ডা শেষে আলোচনা এবার একটু ভিন্ন দিকে নেওয়া যেতে পারে। আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের ছাত্ররা যেসব বই পড়ে সিনেমার জ্ঞান আহরণ করছেন, তার বেশির ভাগই দেখা যায় হয় পশ্চিমা স্কলারদের লেখা, নয়তো ভারতীয় লেখকদের বই। চলচ্চিত্র বিষয়টা প্রচণ্ড অবারিত। একেবারেই মুক্ত। অতএব জানতেও হয় অনেক। অনেক মানে, এই অনেকের কোনো সীমা–পরিসীমা নেই। জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব। তাই আমি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ছাত্রদের জন্য চীন থেকে কিছু ধারণা পাঠানো যায় কি না, সেটা ভাবছিলাম। সিনেমাটাকে চীনের নির্মাতারা কীভাবে দেখেন। তাঁদের এত পুরোনো এবং এত বড় চলচ্চিত্রের বাজার টিকিয়ে রাখতে গিয়ে তাঁদের চলচ্চিত্র ভাবনাটা আজকে কোন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে, সেটা জানা দরকার আমাদের। গত তিন মাস আগে থেকেই একটু একটু করে শুরু করে দিয়েছি চীনের একজন বিখ্যাত তথ্যচিত্রনির্মাতার অডিও ভিজ্যুয়াল ভাষার ওপর লেখা বেশ জনপ্রিয় একটা বই বাংলায় অনুবাদের কাজ। এক অধ্যায় অনুবাদ করি আর লেখকের সঙ্গে বসে সেটা নিয়ে আলোচনায় বসি। যাতে যতটুকু সম্ভব মূল ভাবনাটার কাছাকাছি গা ঘেঁষে থাকা যায়।