নেপালের আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত বিতর্ক প্রতিযোগিতার সেরা বিতার্কিক বাংলাদেশের ফারহান

সেরা বিতার্কিক হন ফারহান (বামে) এবং সেরা দশে ষষ্ঠ অবস্থান অর্জনকারী আহমেদ ইমতিয়াজ সামাদ
সেরা বিতার্কিক হন ফারহান (বামে) এবং সেরা দশে ষষ্ঠ অবস্থান অর্জনকারী আহমেদ ইমতিয়াজ সামাদ


১৪ জুলাই বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা প্রায়। কাঠমান্ডুর থামেলে জেভিয়ার্স একাডেমির হলরুম ভর্তি দর্শকের উদ্দেশে জাপানিদের মতো মাথা ঝুঁকিয়ে বাউ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছেন একটা ছেলে। মুহুর্মুহু করতালি বর্ষণে খুশি, আবেগ ও লজ্জার অদ্ভুত ত্রিমুখী মিশ্রণে হালকা লালচে গাল!  মাত্রই এক অভূতপূর্ব কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি! বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শেষে এসে বিতর্ক শুরুর মাত্র বছরখানেকের মধ্যে আন্তর্জাতিক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথমবার অংশ নিয়েই সেরা বিতার্কিক হয়ে গেছেন! নেপালের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত বিতর্ক প্রতিযোগিতা ‘পঞ্চম মহাসংগ্রাম’-এ অংশ নেওয়া ৬০টি দলের ১২০ জন বিতার্কিকের মধ্যে এবার সেরা বিতার্কিক ছেলেটা! অথচ দেশেই যার কিনা কোনো দিন বিতর্ক করার কথা ছিল না!

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষার্থী ফারহান রহমান এমনই। প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে অজেয়কে জয় করাই তাঁর নেশা। একসময় ব্যক্তিজীবনের হতাশায় অন্ধকারে হারাতে বসা ফারহান বিতর্কের ছোঁয়ায় এখন নতুনদের জন্য আলোর দিশারী। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় বিতর্ক সংগঠন জেইউডিও এর ইংরেজি বিতর্কের যুগ্ম সম্পাদক ফারহান স্বল্প সময়েই বিতর্ক ভুবনে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। আইবিএ ডিবেট ক্লাবের সভাপতিও হয়েছেন অল্পদিনেই। ইংরেজি বিতর্কের সম্পাদক হলেও নিখাদ পরিশ্রমে বাংলা-ইংরেজি উভয় মাধ্যমেই সাবলীল বিতার্কিক তিনি। নিজে যেমন বিতর্ক করতে ভালোবাসেন, তেমনি নতুনদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিতার্কিক হিসেবে গড়ে তোলাতেও তাঁর কোনো ক্লান্তি নেই। বিতর্কের জন্য তাঁর সাধনা প্রশ্নাতীত।

শুরুর গল্পটা বলছিলেন ফারহান- ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শুরুতে ব্যক্তিগত জীবনে নানা ঘটনায় হতাশায় মুষড়ে পড়েছিলাম। একদিন এক ছোটভাই এসে বলল বিতর্ক করে দেখেন, ভালো লাগতে পারে। তার কথায় বিতর্ক শুরু করলাম। যোগ দিলাম জেইউডিও-এর নিয়মিত বিতর্ক অধিবেশনে। প্রথম দিকে ভয় লাগত, যা বলতে চাইতাম বলতে পারতাম না। জেদ চাপল মনে। শ্রেণিকক্ষের পড়ালেখার বাইরে বিতর্কই হয়ে উঠল জীবন। নিয়মিত সিটিংয়ে ঝালাই করতে থাকলাম নিজেকে। অবশেষে ধীরে ধীরে সফলতা ধরা দিতে শুরু করল।’

বিতর্ক তাঁর জীবনটাই পাল্টে দিয়েছে জানিয়ে ফারহান বলেন, ‘আমাদের সমাজে যে কথাগুলো আমরা বলতে চাই, বলা দরকার, তা বলতে আমরা ভয় পাই। বিতর্ক এমন একটা মাধ্যম, যেখানে না বলতে পারা কথাগুলোই বলা যায় অবলীলায়। সামাজিক সংস্কার আর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজের মত জানিয়ে দেওয়া যায় যুক্তি-তর্কে। জীবনে যে কিছু জায়গায় রুখে দাঁড়াতে হয়, ঘুরে দাঁড়াতে হয়, এটাই শেখায় বিতর্ক।’

ভবিষ্যতে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে বিতর্ক করে বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের জন্য আরও বড় কিছু অর্জনের স্বপ্ন দেখেন ফারহান। স্বপ্ন দেখেন, একদিন এ দেশের সব তরুণ-যুবক বিতার্কিক হয়ে উঠবেন, যুক্তি দিয়ে কথা বলবেন। সামাজিক সব অসঙ্গতি যুক্তিতে পিষে ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।

১২-১৪ জুলাই ডিবেট নেটওয়ার্ক নেপাল আয়োজিত ৫ম বার্ষিক মহাসংগ্রাম নামে নেপালের সর্ববৃহৎ এই আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় ফারহানের সঙ্গী ছিলেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বিতার্কিক আহমেদ ইমতিয়াজ সামাদ। তাঁদের দুজনের দল নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ আন্তর্জাতিক ১২০ জন বিতার্কিকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে গ্রুপ পর্বে সেরা দল হয়ে ফাইনালে উঠে যায়। ফাইনালে অল্পের জন্য চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। কিন্তু প্রথমবার অংশ নিয়েই গ্রুপ পর্বে সেরা দল এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রতিযোগিতার সেরা বিতার্কিক হন ফারহান এবং সেরা দশে ষষ্ঠ অবস্থান অর্জন করেন আহমেদ ইমতিয়াজ সামাদ।