মেঘকন্যার দেশে ড্যাফোডিল বন্ধুসভা

মেঘকন্যার দেশে ড্যাফোডিল বন্ধুসভা
মেঘকন্যার দেশে ড্যাফোডিল বন্ধুসভা


১৬ জুলাই সন্ধ্যা। রাজধানীর পান্থপথে শ্যামলী বাস কাউন্টারে একে একে হাজির হলেন ড্যাফোডিল বন্ধুসভার ৩৬ জন বন্ধু। কেউবা এসেছেন মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কেউ আবার পুরান ঢাকা, আজিমপুর, উত্তরা থেকে। সবার হাতে-পিঠে ব্যাগ। গন্তব্য একটাই। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির কয়েকটি দর্শনীয় স্থান দেখা।

মেঘকন্যার দেশে ড্যাফোডিল বন্ধুসভা
মেঘকন্যার দেশে ড্যাফোডিল বন্ধুসভা


গাড়ি খাগড়াছড়ির উদ্দেশে রওনা হবে রাত ১০টায়। কিন্তু সন্ধ্যা থেকেই কাউন্টারে অপেক্ষারত বেশ কিছু বন্ধু। তাঁদের মধ্যে কেউ বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন আর হাঁটাহাঁটি করছেন। তবে অনেকের মনে চিন্তা ছিল ঠিকমতো ঘোরা হবে কি না। কারণ, তখনো আকাশের অবস্থা ভালো ছিল না। ঢাকার আকাশ মেঘলা ছিল।

মেঘকন্যার দেশে ড্যাফোডিল বন্ধুসভা
মেঘকন্যার দেশে ড্যাফোডিল বন্ধুসভা


রাত তখন নয়টা। পথিমধ্যে ড্যাফোডিল বন্ধুসভার ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালের কয়েকজন বন্ধু কাউন্টারে উপস্থিত হলেন। ভ্রমণেচ্ছু বন্ধুদের শুভকামনা জানাতে মূলত তাঁদের আগমন। আহনাফ কবির, মিরাজ হোসাইন, নাহিদ শাকিল, আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেত ইবনেকার নাইম ও ইন্দিরা চাকমা বন্ধুদের শুভকামনা জানান।

যথাসময়ে গাড়ি ছুটল খাগড়াছড়ির পথে। ৩৬ জন বন্ধুর নেতৃত্ব দেন ড্যাফোডিল বন্ধুসভার রাইয়ান এইচ সরকার, মেহেদি হাসান, তাহসিন আহমেদ, আল ইমরান নয়ন ও সোহান হোসাইন। আর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলাম আমি ড্যাফোডিল বন্ধুসভার সাবেক সভাপতি।

৩৬ জনের রিজার্ভ বাস ছুটছে দ্রুতবেগে। বন্ধুরা মনের অজান্তেই গেয়ে উঠছেন গান ‘লাল পাহাড়ের দেশে যা’ ছাড়াও নানা রকমের দেশাত্মবোধক গান। সারা রাত অনেকেই জেগে জেগে রাস্তার দুধারের সৌন্দর্য দেখেছেন আর গুনগুন করে গেয়েছেন গান। কেউবা ঘুমের রাজ্যে হারিয়েছেন সকালে সতেজ মন নিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য।

১৭ জুলাই বেশ ভোরেই বন্ধুদের গাড়ি পৌঁছাল খাগড়াছড়ি শহরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হলো পূর্বনির্ধারিত তিনটি চান্দের গাড়ি। বন্ধুরা সকালের নাশতা খেয়ে রওনা দিলেন দীঘিনালা ঝুলন্ত ব্রিজের দিকে। সকাল ৭টা ৪৫ মিনিট থেকে ৯টা ৩০ পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করলেন। এরপর রওনা দিলেন সাজেকের উদ্দেশে। মাঝপথে দীঘিনালা সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে থামতে হলো। মূলত দীঘিনালা থেকে সেনাবাহিনী নিরাপত্তা দিয়ে ভ্রমণপিপাসু মানুষদের সাজেকে নিয়ে যায়। সকাল ১০টার পর সেনাবাহিনী সাজেকের উদ্দেশে রওনা দেয়। সেনাবাহিনীর দপ্তরে নাম লেখানোর পর চান্দের গাড়ি, সিএনজি ও মোটরসাইকেলযোগে বহু ভ্রমণপিপাসুরা নিরাপত্তাবলয়ের মধ্য দিয়ে সাজেকে উদ্দেশে রওনা দেন। ড্যাফোডিল বন্ধুসভার তিনটি চান্দের গাড়ি ছুটে চলল অন্যদের সঙ্গে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ক্যাম্পে থামতে হলো।

একসময় বাঘাইহাট, মাচালং বাজার, রুইলুইপাড়া হয়ে উঁচু-নিচু পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আমাদের গাড়ি বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে পৌঁছাল সাজেকে। আমরা পূর্বনির্ধারিত মোনঘর নামের একটি কটেজে উঠলাম। কটেজ থেকে দেখা যায়, সবুজে মোড়া পাহাড় ও মেঘের ভেলা। সাজেকে নেই বিদ্যুৎ-সুবিধা। তাই জেনারেটর দিয়ে কটেজগুলোতে দিনে এক ঘণ্টা ও রাতে তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ-সুবিধা দেওয়া হয়।

আমাদের দুপুরের খাবার স্থানীয় সাজেক চিলেকোঠা রেস্টুরেন্টে। বন্ধুরা পাহাড়ের পরিচিত খাবার বাঁশকোরল, ভর্তা ও সবজি খেয়ে বেশ তৃপ্তি নেন। এরপর বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে যাই কংলাক পাহাড়ে। সাজেকের পাশেই কংলাক পাহাড়। ১৫ মিনিটের দূরত্ব। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৮০০ ফুট উচ্চতায় এই পাহাড়। বলে রাখা ভালো, সাজেক ও কংলাক পাহাড় সবই রাঙামাটি জেলার অধীনে। অনেকেই ভুল করে খাগড়াছড়ির অধীন বলে থাকেন। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে বন্ধুরা যখন ঘুমান, মাঝরাতে সাজেকে নামে ঝুম বৃষ্টি। আর সকালে জমে থরে থরে শক্ত মেঘ। মাঝেমধ্যে আবেগি মেঘ উড়ে উড়ে মিশে যায় মনে ও মুখে।

১৮ জুলাই বন্ধুদের সাজেক ছাড়ার দিন। সকালের নাশতা খেয়ে গ্রুপ ছবি তুলে বন্ধুরা অপেক্ষারত কখন সেনাবাহিনীর ডাক আসবে। সকাল ১০টার পরই ডাক এল। সারি সারি গাড়ি ছুটে চলল সেনাবাহিনীকে অনুসরণ করে। বন্ধুরা বারবার পেছন ফিরে তাকাতে থাকলেন আর দেখলেন দুই পাশের দৃশ্য।

দুপুরে বন্ধুদের গাড়ি পৌঁছাল খাগড়াছড়ি শহরে। পাহাড়ি ফল খেয়েই চলল দুপুরের যাত্রা। এদিনের গন্তব্য বাংলাদেশের সবচেয়ে গতিবেগের রিসাং ঝরনাতে গোসল করা। বিকেল চারটা পর্যন্ত বন্ধুরা ঝরনাতে গোসল করলেন। এরপর ছুটলেন আলুটিলা গুহায়। ভয়ে ভয়ে মনোরম পাহাড়ি গুহা অতিক্রম করে অন্য রকম অনুভূতি নিয়ে শেষ হলো বন্ধুদের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ। তারপর আবার খাগড়াছড়ি শহরে ফেরা, সেখান থেকে বাসযোগে ব্যস্ততম রাজধানীতে ফিরে আসা।

বন্ধুরা তিন রাত দুই দিনের জন্য সবুজে মোড়া পাহাড়, বন, ধূসর মেঘেদের ভেলা ও প্রকৃতির কন্যা ঝরনাকে শুধু দেখেননি, বরং এই পুরো দৃশ্য মনের রাজ্যে এঁকেছেন সুনিপুণভাবে। কেউবা ফেলে এসেছেন মন ফিরে যাওয়ার জন্য।