চীনকে চিনি-৪

চীনকে চিনি-৪
চীনকে চিনি-৪


দীর্ঘ ভ্রমণ শেষ। কুনমিং, ফুজিয়ান, হুপেই হয়ে আবার কুনমিং প্রায় ৮ হাজার কিলোমিটারের এই দীর্ঘ ভ্রমণে আমার সময় লেগে গেল গোটা ২৫ দিন। ইচ্ছে ছিল আরও কিছুদিন ঘুরব। কিন্তু পকেটের আহাজারি শুনে আর এগোনো গেল না। গত কিস্তির লেখাটা নান'আংয়ে বসে লিখেছিলাম। ওখানে কিছুটা অবসর পাওয়া গিয়েছিল। এক চায়নিজ পরিবারের কাণ্ডকারখানা লক্ষ করতে গিয়ে বেশ কয়েক দিন নান'আংয়ে থেকে গেলাম। শহরটা ছাড়ার পর আর সময় করে উঠতে পারিনি যে দিনে দিনে গল্প যা জমছে তা লিখে ফেলব। এখন একেবারে ইউভার্সিটিতে ফিরে এসেই লিখতে বসেছি। 

চীনের এই তিনটা প্রদেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে বিমান, বুলেট ট্রেন, ভাড়ার ট্যাক্সি আর সাইকেল এগুলোকে যানবাহন হিসেবে ব্যবহার করতে হয়েছে। সাইকেল চালিয়ে শহর গ্রাম ঘুরে দেখায় একটা সুবিধা আছে। অলিগলিতে ঢুকে যাওয়া যায়। ইচ্ছে হলেই ব্রেক কষা যায়। তার মানে চীনের অলিগলিতে ইচ্ছেমতো ব্রেক কষে কষে কতটুকু গল্প নিজের ভেতর ধারণ করলাম তার একটা ছোটখাটো ফিরিস্তি আজ এখানে তুলে দিই।

চীন সুন্দর। সাগর, পাহাড়, নদী, ঝরনা, চাঁদ, জ্যোৎস্না, দেশভর্তি সুখী সুখী মানুষ ও মানুষের মাথার ওপর মস্ত আকাশ, এর সবই আছে।
আমি চীনের পূর্বদিকের সাগরটা দেখতে গেলাম। এটার নামই ‘তোং হাই’ বা বাংলায় বলা যায় ‘পুব দরিয়া’। পুব দরিয়ায় আমি যে পাশটায় গিয়েছি, সেখানে আমাদের দেশের কক্সবাজারের মতো লম্বা সৈকত দেখা গেল না। সৈকতের বদলে দেখা গেল পাহাড়, পাথর আর ছোট ছোট দ্বীপ। সমুদ্র দেখতে হচ্ছে পাহাড়ের ওপর উঠে। মন একটু খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম সমুদ্র দেখেই নোনতা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ব। ঢেউয়ের সঙ্গে টক্কর দিয়ে কিছুক্ষণ লাফালাফি করব। সব পরিকল্পনা হাওয়া হয়ে গেল কি না সেটা একটু ভাবাছিলাম। সমুদ্রে আমি নামবই এই শপথ ভেতরে গিট্টু দিয়ে রেখেই পাহাড়ের ওপর থেকে সমুদ্র দেখা শুরু করেছি। দেখলাম উঁচু পাথরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রকে এইভাবে দেখাটাও খুব একটা খারাপ না। সুন্দর। সামনে অথই নীল জল। সে জলে ছোট ছোট ফিশিং বোটগুলোকে বাচ্চাদের খেলনার মতো মনে হয়। চারপাশে প্রচুর হাওয়া। সেই হাওয়া কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে। কিছুদূর পরপর তালগাছের মতো উইন্ড মিল বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। বড় বড় পাখা ঘুরছে। গুদামে বিদ্যুৎ জমছে।
আমার ধারণা মতে, কোনো জায়গা সম্পর্কে আরও ভালো করে জানতে হলে সেই এলাকার আর্ট মিউজিয়ামগুলো ঘুরে দেখা দরকার। শিল্পীদের চোখে সেই এলাকার সৌন্দর্য কীভাবে ফুটে উঠেছে সেটা দেখা জরুরি। আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, সমুদ্রের পাশেই একটা আর্ট মিউজিয়াম আছে। চায়নার এবং বিশ্বের অনেক আর্টিস্ট যখন এই জায়গায় ঘুরতে বা আর্ট ক্যাম্পে আসেন, তখন তাঁরা ছবিটবি যা আঁকেন সেসব নিয়েই মূলত এই মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আমি দেখার লোভ সামলালাম না। সমুদ্র থেকে ছুটে গেলাম মিউজিয়ামে। দেখি পুব দরিয়ায় আমি যে স্থানগুলোকে বেশি পছন্দ করেছি, সেগুলোর অনেকই শিল্পীরা এঁকেছেন তেলরং দিয়ে। যাক, আমার ভেতরে তাহলে কিছুটা শিল্পদৃষ্টি গজাচ্ছে।
সমুদ্রের গল্প এখানে শেষ করি। আমি শেষমেশ কিন্তু অন্য পাশে একটা ছোট সৈকত খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু টক্কর দেওয়ার মতো সেই সৈকতে খুব একটা ঢেউ ছিল না।

চীনকে চিনি-৪
চীনকে চিনি-৪


দীর্ঘ চীন জীবনে আমার চোখ সয়ে যাওয়া বিষয়টা হলো, এই দেশের মানুষ মূলত নন-রিলিজিয়াস বা কোনো ধর্মে বিশ্বাসী না। সংখ্যাটা শতকরা ৬০ ভাগেরও ওপর। কিন্তু চায়নিজ মিথলজির গল্পগুলো চীনের হাজার বছরের ঐতিহ্য হিসেবে প্রত্যেকেই এই দিবস এবং উৎসবগুলো বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে পালন করে। ফুজিয়ানে গিয়ে দেখলাম ভিন্ন চিত্র। এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। পুরো ফুজিয়ানজুড়েই শত শত বৌদ্ধমন্দির চোখে পড়ে। এক একটা মন্দির বেশ পুরোনো এবং গঠনশৈলী শৈল্পিক। আমি বেশকিছু বৌদ্ধমন্দির ঘুরে দেখেছি। যেখানে বুদ্ধের পাশাপাশি চায়নিজ মিথলজির চরিত্রগুলোও জায়গা করে নিয়েছে। আবার একই এলাকায় দেখা গেল সাড়ে ৭০০ বছরের পুরোনো মসজিদ। ইরান এবং আরবের অন্যান্য দেশ থেকে আসা ধর্মপ্রচারকেরা এই এলাকায় কিছুটা ইসলাম প্রচার করেছেন সেটা মসজিদের পাশে ‘দ্য এক্সিভিশন সেন্টার অব ছুয়েঞ্জো’ নামক জাদুঘরটা ঘুরে জানতে পারলাম।

ফুজিয়ান অঞ্চলের একটা সুন্দর বিষয় হলো, বাড়িঘরগুলোর একটা নিজস্ব ধরন আছে। নিজস্ব রং আছে। বাড়ির ছাদে ছোট ছোট পোড়া মাটির টালি বসানো (ছাদের চিত্র পরিষ্কার করতে গিয়ে এখানে 'টালি' শব্দটা কতটুকু জুতসই হচ্ছে তা নিয়ে আমি কিছুটা সন্দিহান)। চায়নিজ চলচ্চিত্রে এসব বাড়িঘর দেখা যায়। ছাদের আকৃতি অনেকটা দুই মাথি নৌকার মতো। এটা ফুজিয়ানের ঐতিহ্য। উঁচু দালান কোঠাগুলোর ছাদেও এই নির্দিষ্ট রং এবং আকৃতি ব্যবহার করা হয় যাতে ঐতিহ্য ধরে রাখা যায়।

এই অঞ্চলের মানুষ ভয়ংকর রকমের অতিথিপরায়ণ সে গল্প আগের পর্বে (চীনকে চিনি ৩–এ) লিখেছি। এখন দিই ভিন্ন তথ্য। গল্পে গল্পে জানা গেল ফুজিয়ান নামক এই প্রদেশটায় একটা সময় কোনো জনবসতি ছিল না। ইতিমধ্যেই যখন চীনের অন্যান্য অঞ্চলে সুপরিচিত জনপদ দাঁড়িয়ে গেছে। যখন থেকে বসতি গড়া আরম্ভ হলো, তখন থেকেই একজন অপরকে সহযোগিতার প্রয়োজন শুরু হয়ে গেল। তাদেরকে একটা অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাই সংস্কৃতিতে ঢুকে গেল একটা নতুন ব্যাপার, সবাই এসে এই অঞ্চলে আদর আপ্যায়ন পাবে। এতে অতিথির দ্বারা ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের কিছুটা উপকার হলেও হতে পারে। আধুনিক চীনের মানুষ একেবারে স্পষ্টভাবেই ব্যবসায়িক মানসিকতার। বিনিময়ের তোয়াক্কা তারা করে। ফুজিয়ান অঞ্চলের এই আপ্যায়নে আমি মুগ্ধ হয়ে বসে থাকতে পারতাম। কিন্তু খেয়াল করলাম যেখানেই গিয়েছি অন্যান্য আলোচনার পাশাপাশি হালকা ব্যবসায়িক আলোচনাও তারা সঙ্গে জুড়ে দেয়।

চীনকে চিনি-৪
চীনকে চিনি-৪


ইউনান প্রদেশের মধ্যবয়স্কা মহিলারা সন্ধ্যায় একত্র হয়ে গানের তালে তালে হালকা নাচানাচি করেন। আমি ভাবতাম এটা কেবল ইউনানের চর্চা। দেখি চীনের অন্যান্য প্রদেশের এই চর্চা রীতিমতো প্রতিযোগিতায় রূপ নিয়েছে। বড় বড় ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে খোলা ময়দানে মন খুলে নাচানাচি করছেন ৩০ ঊর্ধ্ব মহিলারা। ক্লাবভিত্তিক নাচের কয়েকজন শিক্ষকও থাকেন। যাঁরা নাচে সবাইকে নেতৃত্ব দিয়ে যান সামনে থেকে। আমি এমন এক নাচের শিক্ষকের সঙ্গে সুযোগ পেয়ে কথা বলে ফেললাম।

আপনাদের ঘটনাটা আমাকে একটু খুলে বলেন তো, দল বেঁধে প্রতিদিন এমন মন খুলে নাচার কারণ কী?
শিক্ষক উত্তর দেন, বয়স ত্রিশের পর থেকে মেয়েরা নিজেদের দিকে নজর দেয় কম। এতে মুটিয়ে যায়, শরীরে নানান রোগবালাই বাসা বাঁধে। এই কারণে আমরা ক্লাব করে সবাইকে নিয়ে নাচি। এটা বিনোদনমূলক শরীরচর্চা। আমরা এক ক্লাব অন্য ক্লাবের সঙ্গে প্রতিযোগিতা দিই। এ কারণে নিজেদের ভেতর একটা ভালো করার মানসিকতা থাকে। তাই সবাই প্রতিদিনই আসে নাচতে। শারীরিকভাবেও সুস্থ থাকা হয়, বিনোদনও হয়।

বাহ, কি বুদ্ধি! তাই তো বলি, এরা সব সময় এত হাসিখুশি কেন?