কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সভার 'পথের পাঁচালী'

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সভার ‘পথের পাঁচালী’।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সভার ‘পথের পাঁচালী’।


বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী উপন্যাস নিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার পাঠচক্র অনুষ্ঠিত হয়। বৃহস্পতিবার বিকেলে ক্যাম্পাসের কাঁঠালতলায় এ পাঠচক্রের আয়োজন করা হয়।
পরিচয় পর্ব শেষে পাঠচক্র সম্পাদক তাঁর বক্তব্য শুরু করেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘পথের পাঁচালী উপন্যাস হলেও পড়ার সময় একটিবারের জন্যও মনে হয় না যে এটা উপন্যাস! বরং লেখকের স্বচ্ছ ও সাবলীল ভাষায় আমাদের তৎকালীন সমাজের বাস্তব ও জীবন্ত ছবিটিই সহজ ও স্বাভাবিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাসে।
‘আমরা কখনো কী ভেবেছি যে একজন নারীর কী রকম অনুভূতি হয়, যখন তিনি ক্রমাগতভাবে নির্যাতিত, অবহেলিত, নিগৃহীত হন? তাঁর কোনো আয়ের উৎস নেই, ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, গঠনগত দুর্বলতা ইত্যাদির কারণে? যখন একজন নারী তাঁর জীবনের শেষ দিনে চলে আসে, তখন তাঁর সামাজিক পরিস্থিতি কেমন হয়? যখন কোনো নারী অল্প বয়সে স্বামীহারা হন এবং সমাজ তাঁকে আবার বিয়ে করার অনুমতি দেয় না, তখন সেই নারীর সামাজিক অবস্থান কোথায় দাঁড়ায়? এই সব প্রশ্নের উত্তর অত্যন্ত নিখুঁতভাবে রয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী উপন্যাসে। এই উপন্যাসের প্রথম অংশে আমরা তৎকালীন সমাজব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি বাল্যবিবাহ ও যৌতুককে দানবীয় আকার ধারণ করতে দেখি। ইন্দির ঠাকুরনের বিয়ে অল্প বয়সে এমনই এক লোকের সঙ্গে দেওয়া হয় যে বেশি যৌতুকের লোভে অন্যত্র বিয়ে করেন এবং আর কখনো ফিরে আসেননি। তখন আয়হীন ইন্দির ঠাকুরনের আবাসস্থল হয় তাঁর পিতার বাড়িতে এবং তাঁদের ও তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর দূরসম্পর্কের আত্মীয় হরিহরের বাড়িই তাঁর স্থান হয়। হরিহরের বাড়িতে প্রতি মুহূর্তে তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া হতো যে তিনি একজন আশ্রিতা, করুণার পাত্রী ছাড়া আর কেউ নন। তিনি প্রায়শই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন, কিন্তু দিন শেষে তাঁর পথ এসে শেষ হতো হরিহরের বাড়িতেই। একবার ঘটনাক্রমে বাড়ি থেকে তাঁকে একেবারে বের করে দেওয়া হয় এবং মর্মান্তিকভাবে তাঁর জীবনের ইতি ঘটে। মৃত্যু হয় অসহায়ত্বের।’

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সভার ‘পথের পাঁচালী’।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সভার ‘পথের পাঁচালী’।


সাধারণ সম্পাদক আফরিন জাহান লুবনা উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশ সম্পর্কে বলেন, আম আঁটির ভেঁপুতে অত্যন্ত সুচারুভাবে হরিহরের সন্তানদ্বয়, বড় মেয়ে দুর্গা ও ছোট ছেলে অপুর টক-মিষ্টি সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। দুর্গা একপর্যায়ে অপুকে মারে। কারণ, সে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে চুরি করে আম খাওয়ার ঘটনা বলে দেয়। এ কারণে তাকে প্রতিবেশীর কথাও শুনতে হয়। রাগের মাথায় দুর্গার মা সর্বজয়া ওকে বকাবকি করেন। উপন্যাসের একপর্যায়ে ম্যালেরিয়া জ্বরের শেষ পর্যায়ে এসে দুর্গা মারা যায়।
সাহিত্য সম্পাদক ফারজানা আফরোজ উপন্যাসের শেষ অংশ সম্পর্কে বলেন, অক্রূর সংবাদে চিরাচরিত বাংলার বড়লোক-গরিবের বৈষম্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে। লেখক সাফল্যের সঙ্গে দেখিয়েছেন যে একজন ব্রাহ্মণ নারীর কী অবস্থা হয়, যখন অর্থের জন্য তাকে কাজের লোকের কাজ করতে হয়। দুর্গার মৃত্যুর পর তারা গ্রাম ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। সেখানে একপর্যায়ে জ্বরে স্বামী হরিহরও মারা যায়। তার অশ্রু মোছার জন্যও কেউ ছিল না। সবাই তার কষ্টের সুযোগ নিতে চায়। সাহায্যের হাত কেউ বাড়ায় না। অবশেষে সে অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ছেলে অপুকে নিয়ে তার নিজ গ্রাম নিশ্চিন্দি পুরের পথে রওনা হয়।
কিন্তু বলা বাহুল্য, এই সামাজিক বৈষম্য আজকের একবিংশ শতাব্দীর উন্নত সমাজেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। বস্তুত এই উপন্যাস আদি ও বর্তমান সামাজিক উত্থান-পতন ও সামাজিক কুসংস্কারেরই প্রতিচ্ছবি বলে মনে করা হয়।
পাঠচক্রে উপস্থিত ছিলেন রাসেল, লুবনা, আফরোজা, ফারজানা, এনামুল, ইশতিয়াক, নজরুল, খোরশেদ, তানিয়া, আরিফ, শুভ, মনির, রুবেলসহ অনেকেই।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা