সিঙ্গাপুরের পরান থেকে-০২

তাসরিফ আহমেদ
তাসরিফ আহমেদ


এয়ারফোর্স ট্রেনিং কমান্ডে যেই প্রজেক্ট চলছিল, সেই টিমে যুক্ত করা হলো আমাকে। পরদিনই কাজে গেলাম, চকরাবকরা আকাশি রঙের পোশাক পরা কত শত তরুণ সেখানে। তাঁদের কারও কারও সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। সাহস করে তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, উদ্দেশ্য পরিচিত হওয়া। হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলেন কয়েকজন। আমিও বোকার মতো হাসতে হাসতে ছোট ছোট ইংরেজিতে নিজেকে প্রকাশ করছিলাম। ঘুরে দেখলাম সেখানকার পরিবেশ। ব্লকগুলো চিনে কাজ করতে কিছুটা সময় লাগল। আমাকে তত্ত্বাবধান করেন এক বার্মিজ সুপারভাইজার। সারা দিন তিনি যে ইংলিশ ব্যবহার করেন তার অর্ধেকই বুঝতাম না। আমার ইংরেজিও তিনি বোঝেন না। প্রথম দিকে সহজ কাজগুলোই আমি করতাম।

এইভাবে কাজে কাজেই দিন, সপ্তাহ, মাস কেটে গেল। বন্ধু তৈরি হলো, অনেক বাঙালি শ্রমিকের সঙ্গে কথা হলো, দেখা হলেই খোঁজখবর নিতাম তাঁদের। যখন দেখতাম একদল বাঙালি শ্রমিক কাজ করছেন পাশে কোথাও, সুযোগ বুঝে দৌড় দিতাম তাঁদের সঙ্গে গল্প করতে। ‘দেশি’ বলে সম্বোধন করতেন কেউ কেউ। ভালো লাগত।

অক্টোবরে তিন মাস হলো আমার সিঙ্গাপুরে থাকার বয়স। আমার জন্মদিনের পর অফিস একদিন আমাকে ডেকে পাঠাল, আমার সবকিছু তাদের ভালো লাগায় আমাকে এয়ার বেজের টিমে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিল। কী কী মেনে চলতে হবে, আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। এর মাঝেই যে অফিস আমার ফাইল ডিফেন্স মিনিস্ট্রি থেকে ক্লিয়ারেন্স অনুমোদনের আবেদন জানিয়েছে, এটা আমার জানা ছিল না।

দেশের এয়ার বেজে বা মিলিটারি ক্যাম্প অথবা আর্মি ক্যাম্পে প্রবেশের সুযোগ হয়নি কখনোই। সেখানে আমি নাকি সিঙ্গাপুর এয়ারফোর্সের বেজে কাজ করব! কতটা সিকিউরিটি সেখানে ভাবা যায়!

খুশি হয়ে অফিস থেকে বের হয়ে আসলাম।

পরদিন পায়া লেবার এয়ার বেজে কাজ করতে হবে। সকালে অন্যদের সঙ্গে পৌঁছালাম, সেখানে ঢুকতে আলাদা সিকিউরিটি পাস লাগে, সেটা ওয়ার্ক পারমিট জমা দিয়ে নিতে হয়।

গেট পার হওয়ার আগে স্ক্যান করা হলো পুরো শরীর।

ভেতরে ঢুকে স্টোর রুমের দিকে যাচ্ছিলাম। দেখা মিলল রানওয়ের, কয়েকটা সি-১৩০ হারকিউলিস (পরিবহন খাতে নিয়োজিত বিমানের এক মডেল) দেখতে পাচ্ছিলাম আবছা। হেলিকপ্টার উড়ছিল।

অল্প কিছু সময়ের জন্য শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম মনে হচ্ছিল, ছোটবেলায় মাথার ওপর দিয়ে যখন বিমান যেত বন্ধুরা সবাই আনন্দের সঙ্গে দেখতাম।

ফিরে আসি এবার আসল কথায়, দিনকাল ভালোই যেতে শুরু করল। সবকিছুই বুঝে উঠতে শিখছি।

দুই মাস পর অন্য এয়ার বেজে বদলি করা হলো আমাকে।

সেটা আবার এয়ার কম্ব্যাট কমান্ডের বেজ। সেখানে ফাইটারগুলোর (যুদ্ধবিমান) ডিটাচমেন্ট ফ্লাইয়ের বিকট শব্দ খুব বিরক্ত লাগত। যতবার ফাইটারগুলো রানওয়ে থেকে উড়াল দিত, ততবার কান চেপে ধরে রাখতাম, কারণ ডিটাচমেন্টের সময় জেটগুলো প্রায় ১৪০ ডেসিবল শব্দ সৃষ্টি করত। যেটা সহ্য করা দায়।

তারপর সেটাও অভ্যাস হয়ে গেল।

এখন এয়ার বেজের সেই রানওয়ের সঙ্গে গড়ে উঠেছে আমার সখ্য। ফাইটার এফ-১৫ এসজি, এফ-১৬ সি/ডি, এ.ই.ডব্লিউ এখন যেন আমার বন্ধুর মতোই। বিকট শব্দগুলো আর বিরক্ত লাগে না। অন্য রকম এক ভালোলাগা তৈরি হয়ে গেছে। সার্চার, হিরণ, হামবস, ড্রোন, ফকার, গালফস্ট্রিম, স্ট্রেটোট্যাঙ্কর অথবা ফাইটার কিংবা হেলিকপ্টার, কত এয়ারক্রাফট দেখলাম এক বছরে!

যেগুলো কিনা সারা বছর সিঙ্গাপুরের আকাশ পাহারায় ব্যস্ত। সবকিছু ভাবতেই অবাক লাগে।

বিশাল কম্পার্টমেন্টে পার্ক করা হয় ফাইটারগুলো। কাজের উদ্দেশ্যে যাওয়া হয় সেখানে।

কিন্তু সেই সুযোগ আর কই!

একদিন এক পাইলট ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী করো এখানে? সহজসরল উত্তর দিলাম, ‘এয়ারকন কন্ট্রাক্টর, এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেম নিয়ে কাজ করি।’

কিছুক্ষণ পর আমার ইংরেজির প্রশংসা করে বিদেশি চকলেট হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর চকলেটের লোভে অনেকবার খুঁজেছি তাঁকে, পাইনি।

তেঙ্গাহ এয়ার বেজের মিলিটারি, এয়ারফোর্স পার্সোনেলরা এখন যেন আপন হয়ে উঠেছেন, দেখা হলেই ইশারায় কথা হয়। কখনোবা আমিই কাজের তাগিদে তাঁদের কাছে যাই। তাঁরা আসলেই অনেক বন্ধুসুলভ, কখনোই একজন শ্রমিক বা অভিবাসী মনে করেন না আমাকে। ভালোবেসে অনেক উপহারও পেয়ে থাকি তাঁদের কাছ থেকে।

এখানে কাজ করতে আমাকে ছাড়তে হয়েছে সব অলসতা। ছোট ছোট কাজ পরিশ্রমের সঙ্গে দ্রুত শেষ করতে হয়। সময় মেনে সব কাজ করার প্রবণতাও বেশি। কমিউনিকেশন স্কিল, লিডিং স্কিল খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেটা আমি আমার সাংগঠনিক জীবনে শিখেছি, বিশেষ করে বন্ধুসভা থেকে।

সেটা স্বাচ্ছন্দ্যে এখন কাজে লাগাই।

আমার এই ছোট্ট জীবনে এই পাওয়াগুলো নিজের কাছে অনেক বড় মনে হয়।

ভবিষ্যতে ইচ্ছা আছে বিদেশের মাটিতে লেখাপড়া শেষ করে ভালো কিছু করার।

এখানে অনেক কিছুর মধ্যেও একা নই আমি, যুক্ত হয়েছি দুটি সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে। যারা বিশেষ করে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে। সেখানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সময় দিই। সংগঠনের পরিচয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে গড়ে উঠেছে বন্ধুত্ব, সময় পেলে গল্প করি, আড্ডা দিই।