এরাই তৈরি হবে, এরাই এগিয়ে যাবে

২০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ ও ময়মনসিংহ বন্ধুসভার আয়োজনে ‘তৈরি হও এগিয়ে যাও’ শীর্ষক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। ময়মনসিংহ টাউন হল তারেক স্মৃতি মিলনায়তনে।
২০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ ও ময়মনসিংহ বন্ধুসভার আয়োজনে ‘তৈরি হও এগিয়ে যাও’ শীর্ষক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। ময়মনসিংহ টাউন হল তারেক স্মৃতি মিলনায়তনে।


আমার বেডরুমের দক্ষিণের জানালার পাশেই বিছানা। বালিশে মাথা দিয়েই আকাশ দেখা যায়। মাঝেমধ্যে তারা গুনি। আবার জোছনার ঝলসানো রূপ দেখে মনটা বিষণ্নতায় ছেয়ে যায়। চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই যাকে বলে অখণ্ড অবসর মেলেনি একবারও।

বিভিন্ন সংগঠন, আবৃত্তি, বিতর্ক, রেডিওতে দৌড়ে বেড়ানো যার ১০ বছরের অভ্যাস, সে ৯টা-৫টা অফিসের বেড়াজালে ১০ মাসেও হাঁপিয়ে উঠবে না, তা কী করে হয়!
নিজের কথাই বলছি। কয়েক দিন ধরেই মনে হচ্ছিল নিজের জন্য একটু সময় দরকার। শুধুই নিজের জন্য। কী করা যায় ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ফোন এল। প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ আয়োজিত ‘তৈরি হও এগিয়ে যাও’ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালায় শুদ্ধ উচ্চারণের ওপর আলোচক হিসেবে থাকতে হবে। তাও আবার নওগাঁ থেকে সুদূর ময়মনসিংহ। ভাগ্য এতটা সুপ্রসন্ন হবে ভাবিনি কখনো। রাজশাহীর বাইরে যাওয়ার সুযোগ কমই হয়েছে। কোনো কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেছি। আর কিছু না হোক চেনা আকাশের বাইরে গিয়ে একটা দিন তো ভিন্ন আকাশের তারা গুনতে পারব। আপাতত এতেই চলবে।

যথারীতি ব্যাগ গুছিয়ে অফিস শেষে রওনা হলাম। বাসভ্রমণে আমি সব সময় ঘুমিয়ে পড়ি। বাস যখন ময়মনসিংহের টাউন হল মোড়ে নামিয়ে দিল, তখন রাত প্রায় ১০টা। এলোমেলো উষ্কখুষ্ক চুলে কোনো এক জঙ্গল থেকে উঠে আসা প্রাণী মনে হচ্ছিল নিজেকে। যদিও রাতের নিয়ন আলোয় চেহারা দেখার উপায় নেই; শরীরজুড়ে ধুলাবালুর অস্তিত্ব উপলব্ধি করে এই অনুভূতির উদয় হলো।

হোটেলে পৌঁছে লিফট থেকে নেমেই দেখি সেই মানুষটি, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি দন্ত্যস রওশন। যে মানুষটির সঙ্গে কথা হয়েছে ফোনে, ছবি দেখেছি ফেসবুকে বা কোনো সাক্ষাৎকারে। সেই প্রথম দেখলাম সাক্ষাতে। সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন—ইশরাত জাহান ইভা ও খায়রুন্নাহার খেয়া। তাঁরাও এই অনুষ্ঠানের আলোচক, ঢাকা থেকে এসেছেন। এত অল্প সময়ে কেউ এতটা আপন হতে পারে, এঁদের না দেখলে বুঝতাম না। আমাকে দেখে রওশন ভাইয়ের প্রথম বাক্য ‘এখনই আপনার কথা এদের বলছিলাম (ইভা ও খেয়াকে নির্দেশ করে)। তানিয়া আসছে।’ এই সুললিত বাক্যখানা আমাকে যেন জঙ্গল থেকে মনুষ্য পরিবারে ফিরিয়ে আনল। ইভা ও খেয়ার সঙ্গে পরিচয় পর্ব শেষে ঝটপট ডিনারে বেরিয়ে পড়া। খাবারের অর্ডার দিয়ে শুরু হলো ইভা, খেয়া ও আমার ফটোশুট। ফটোগ্রাফার স্বয়ং দন্ত্যস রওশন ভাই। এ যেন মহাকালের স্রোতে খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়ে জীবন পূর্ণ করা অনুভূতি। খেয়েদেয়ে হোটেলে ফেরার পথেই পরদিনেই সেশন বুঝিয়ে দিলেন রওশন ভাই। আমাদের সঙ্গে আরও কজন আলোচক ছিলেন।

যথারীতি পরদিন অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হলাম। শুরুতেই ডাকা হলো আমার নাম। মনে মনে যা বলব বলে ভেবেছিলাম, সব ভুলে গেলাম। অগত্যা সিলেটি ভাষায় পাওয়া প্রেমপ্রস্তাব বুঝতে না পেরে পেট খারাপ ভেবে ফিরিয়ে দিয়ে জীবনে যে আফসোস ছিল, তা–ই দিয়েই শুরু করলাম। এ জন্যই প্রমিত বাংলায় শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা জরুরি। বাকিটা ইতিহাস। মঞ্চ থেকে নেমে শুরু হলো মুগ্ধ হওয়ার পালা। একে একে আলোচকদের বিভিন্ন বিষয়ে উপস্থাপনা সীমাহীন ভালো লাগায় রূপ নিতে থাকল। আরও বিমোহিত হলাম যখন কথার জাদুকর দন্ত্যস রওশন ভাই শুরু করলেন। সফলতা আর সার্থকতার মধ্যে তফাত কী, তা এত সুন্দরভাবে এই প্রথম জানলাম। সত্যিই তো, জীবনে অনেকেই সফল হতে পারে, কিন্তু সার্থক জীবন কজন পায়?

‘তোমাদের “তুমি” করে বলা কি ঠিক হচ্ছে? তোমাদের ভেতর থেকেই কেউ আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিকে কি “তুমি” করে বলা যায়।’ এত দৃঢ়তার সঙ্গে ভরসা জাগাতে আগে কাউকে দেখিনি। আরও অবাক করে দিয়ে প্রায় ৫০০ জনের মধ্যে ৫ জন বন্ধু বেরিয়ে এল, যারা কোনো দিন মাকে কোনোভাবেই বিন্দুমাত্র কষ্ট দেয়নি। কোনোভাবেই না। রওশন ভাইয়ের সঙ্গে আমিও মনে মনে ওদের স্যালুট জানিয়েছিলাম।

সুযোগ পেলে সবাই বক্তা হতে চায়, ভালো শ্রোতা পাওয়া দুষ্কর—এ কথাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে প্রায় ৫০০ বন্ধুর সবাই শেষ অবধি অবস্থান ভারি আশ্চর্যের, একই সঙ্গে আনন্দেরও। এরাই তো তৈরি হবে, এরাই তো এগিয়ে যাবে।

সব শেষ হলে সময় বাজায় ঘণ্টা। মাদকের বিরুদ্ধে শপথ নিয়ে সুন্দর–সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের স্বপ্ন বুকে ধারণের প্রত্যয় নিয়ে শেষ হয় দিনব্যাপী কর্মশালা। এ ভালো লাগার কোনো শেষ নেই। দিনবদলের জয়গানে জয়ী হোক বন্ধুসভার বন্ধুরা। সবশেষে কৃতজ্ঞতা দন্ত্যস রওশন ভাইয়াকে ভরসা করে সুযোগ দিয়ে এমন সুন্দর একটি দিন উপহার দেওয়ার জন্য।