মোহনীয় মাগুরার বৃত্তান্ত

মাগুরা বন্ধুসভার সাংগঠনিক বৈঠক শেষে বন্ধুরা।
মাগুরা বন্ধুসভার সাংগঠনিক বৈঠক শেষে বন্ধুরা।


ভায়নার মোড়ে যখন বাস থামল, তখন আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করেছে মাগুরা শহর। হাই তুলতে তুলতে দোকানিরা ঝাঁপ খুলছিলেন, কেউ আবার সামান্য পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিলেন সামনের অংশে। ভায়নার চৌমাথায় দাঁড়িয়ে একটি বিষয় বেশ নজর কাড়ল। সেটা ব্যাট-বল হাতে ভ্যানে করে ছুটে চলা কিশোর দল দেখে। তাদের আলাপ থেকে ভেসে দু–একটা বাক্য থেকে জানা গেল, জেলা স্টেডিয়ামে আজ জমজমাট কিছু হতে চলেছে। মোড়ের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়েই কয়েকজনকে দেখলাম সেদিন বিকেলে অনুষ্ঠেয় ফুটবল ম্যাচ ছক কষতে।

মাগুরা এমন ক্রীড়ামোদীদের শহরে বলেই হয়তো সাকিব আল হাসানের মতো বিশ্বসেরা ক্রিকেটার তৈরি হয়েছে। সাতসকালে মাঠমুখো মানুষের এমন আনাগোনা দেখে ভালোই লাগছিল। তবে এই ভালো লাগার বাইরেও ততক্ষণে দুটি বিষয়ে উৎসাহ ভর করেছে। প্রথমত, সকালের নাশতাটা কোথায় সাড়া যায় (কারণ, প্রতিটি হোটেলে দেখছিলাম ডুবোতেলে ভাজা পরোটা। এমন তেল চপচপে পরোটা দিয়ে দিন শুরু করার সাহস দেখাতে পারছিলাম না!)। দ্বিতীয়টা, জায়গাটার নাম কেন ভায়নার মোড়! কে বা কী এই ভায়না?

মাগুরার এক বন্ধুকে ফোন করে সকালের নাশতার ব্যাপারটা ফয়সালা করতে পারলেও, ভায়নার মোড়ের নামকরণের পেছনের ইতিহাসটা তখন জানা গেল না, দিনভর মাগুরার নানাজনকে জিজ্ঞেস করেও অজানা থেকে গেল, অনাবিষ্কৃত রইল আজও। তবে নতুন কোনো শহরের সেই নরম রোদ মাখা সকালের কথা মনে থাকবে দীর্ঘদিন।

মনে রাখার মতো ১ নভেম্বরের সকালের মতো দিনটাও কেটেছে নানা বিস্ময়ের মধ্যে। সাংগঠনিক সফরের প্রস্তুতি কষতে কষতেও ঘুরে বেড়িয়েছি আটপৌরে শহরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা। দেখেছি শহরজুড়ে উৎসবের প্রস্তুতি। সেই প্রথম জানলাম, কাত্যায়নী পূজার কথা। দুর্গাপূজার বিশালত্বকেও হার মানায় মাগুরার কাত্যায়নী। দেশ-বিদেশ থেকে আসেন পূজারি, অতিথি, দর্শনার্থী। সপ্তাহব্যাপী চলে উৎসব।

একদিন পরই পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে বলে, জোরসে চলছিল প্রস্তুতি। আগ্রহ নিয়ে ঘুরে দেখলাম কয়েকটি মণ্ডপ। কথা হলো প্রতিমা কারিগর আর আয়োজকদের সঙ্গে। জানলাম শত বছরের কাত্যায়নীর ইতিহাস। শহরে ঘুরতে ঘুরতেই মিষ্টির স্বাদ নেওয়া হলো কয়েকটি দোকানে। মিষ্টির দোকানের জৌলুশ যেমনই হোক, প্রতিটি দোকানের মিষ্টি তুলনাহীন, অসাধারণ। রসগোল্লা কিংবা রসমালাই—যাই মুখে পুড়েছি, সেই স্বাদ মুখে লেগে আছে এখনো। 

ঘোরাঘুরি আর পেটপূজার সঙ্গে বিকেলের বৈঠকের কথা কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য ভুলিনি। আগে থেকেই অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিয়েছিলাম। বন্ধুসভার পুরোনো কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে দেখাও হলো। বৈঠকের সময়ও জানানো হয়েছিল দুদিন আগে। আবারও মনে করিয়ে দিতে প্রথম আলোর মাগুরা জেলা প্রতিনিধি কাজী আশিক রহমান সবাইকে ফোন করলেন। শুক্রবার বলে ছুটির আমেজে ছিল সবাই। ঠিক যেন এমন ছুটির আমেজেই মাগুরা বন্ধুসভার কার্যক্রম চলছিল কিছুদিন। তাই কীভাবে মাগুরাসভাকে আরও সংগঠিত করা যায়, সেই বিষয়টি নিয়েই আমরা বসেছিলাম মাগুরার শহীদ আতর আলী গণগ্রন্থাগার মিলনায়তনে। কার্তিকের সেই বিকেলেও শীতের আমেজ টের পাওয়া যাচ্ছিল। সেই আমেজ গায়ে মেখেই ফয়সাল পারভেজ, মুনশি রিফাত হোসাইন, সৈয়দ তাসিন জামান, স্বর্ণালি বিশ্বাস, কবির খান, কাজী আল আমীন, আরাফাত শালুক, জেসিকা রায়হান, রিচি আক্তার, আহমেদ শাওন, তারিক আবদুল্লাহ, এসএ ফাহিমেরা এসে হাজির।

প্রথম আলোর মাগুরা জেলা প্রতিনিধি কাজী আশিক রহমান সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে শুরু করেছিলেন বৈঠক। আগতদের অনেকেই প্রথম কোনো বৈঠকে উপস্থিত হয়েছিলেন সেদিন। তাই গোড়া থেকে শুরু করতে হলো আলোচনা। বন্ধুসভা কী, কেন, তরুণেরা কেন বন্ধুসভা করবে ইত্যাদি বিষয়গুলো তন্ময় হয়ে শুনলেন মাগুরার বন্ধুরা। তাঁরাও নানা অজানা প্রশ্ন নিয়ে উত্থাপন করলেন, উত্তর দেওয়া হলো তৎক্ষণাৎ। দারুণ এক বৈঠক শেষে গণগ্রন্থাগারের সবুজ চত্বরে ছবি তোলা হলো। সবার মধ্যে সেই সবুজের প্রাণচাঞ্চল্য ভর করল। সবাই সংগঠিত মাগুরা বন্ধুসভা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বিদায় নিল গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ।

শেষবারের মতো শহরতলি ঘুরে দেখতে আমরাও বেরিয়ে পড়ি মোটরবাইকে। শহরের কোলাহল পেরিয়ে আসন্ন সন্ধ্যায় পৌঁছে যাই অনতিদূরের এক গ্রামে। সেখানে যেন সফেদ ফুলহীন কাশবনকেও আপন মনে হলো। কাশবনের এক পাশে চায়ের দোকান। দল বেঁধে আসা শহুরে মানুষের সঙ্গে আমরাও চায়ের কাপে চুমুক দিই। এভাবেই একসময় সন্ধ্যা নামে পাশের শান্ত নবগঙ্গা নদীতে। মোহনীয় সেই সন্ধ্যায় মাগুরা জেলা প্রশাসনের জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের স্লোগানটা (মোহনীয় মাগুরা) আচমকা মনে পড়ে। মোহনীয় সেই আবেশ নিয়েই বিদায় জানাই মাগুরার নবগঙ্গাকে। 

সহসভাপতি, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ।