সার্ক সাহিত্য উৎসব ২০১৯

সার্ক সাহিত্য উৎসব ২০১৯
সার্ক সাহিত্য উৎসব ২০১৯


১৮ থেকে ২০ অক্টোবর ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ৫৭তম দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য উৎসব। এই উৎসব আয়োজন করেছে ফাউন্ডেশন অব সার্ক রাইটার্স অ্যান্ড লিটারেচার বা ফোসয়াল। এবারের উৎসবে দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং স্বাগতিক ভারতের কবি–সাহিত্যিকেরা অংশ নেন। এর আগে বিভিন্ন সময় ঢাকা, কাঠমান্ডু, লাহোর, কলম্বো, ক্যান্ডি, মালে, থিম্পু ও ইসলামাবাদে দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য উৎসব অনুষ্ঠিত হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতের দিল্লি, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, জয়পুর ও চণ্ডীগড়ে এই উৎসব নিয়মিত হচ্ছে। এবারের সার্ক সাহিত্য উৎসবে তরুণ শিশুসাহিত্যিক হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম আমিও।

গল্পে গল্পে উড়াল
১৭ অক্টোবর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটু তাড়াহুড়ো করেই পৌঁছাই। এমনিতেই বৃহস্পতিবার, তার ওপর ফ্লাইট বেলা তিনটায়। এর মধ্যে লেখক সেলিনা হোসেন ফোন দিয়ে বললেন, ‘আমার ড্রাইভার ছুটিতে; তুমি যাওয়ার পথে আমায় তুলে নিয়ে যেয়ো। রেডি হয়েই আছি।’ সেলিনা আপার সঙ্গে ভ্রমণে অন্য রকম এনার্জি পাওয়া যায়। মায়ের মতো আগলে রাখেন সারাক্ষণ। তা ছাড়া দিল্লিতে এটাই আমার প্রথম ভ্রমণ। সেলিনা আপা গিয়েছেন অসংখ্যবার। তো সেলিনা আপাকে বাসা থেকে তুলে জ্যাম ঠেলে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখি সময় একেবারেই নেই! তাড়াহুড়ো করে বোর্ডিং কার্ড করতে যাচ্ছি, তখনই মোবাইলে বাংলাদেশ বিমানের টেক্সট। ৪০ মিনিট ডিলে হচ্ছে আমাদের ফ্লাইট। যাক বাবা, হাফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন! সেলিনা আপনা বলেন, ‘আমি তো আগেই টেক্সট পেয়েছিলাম। তুমি পাওনি?’ ‘না আপা’, এই বলে আমরা কাজের গতি কমিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে বসলাম সিটি ব্যাংকের লাউঞ্জে।
ইন্ডিগোর গা-ঘেঁষে বিমান নামল ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।

সাদা ট্যাক্সি কালো ধোঁয়া
দেশ ছাড়ার আগে দিল্লি এয়ারপোর্টের কয়েকটা রিভিউ দেখে নিয়েছিলাম। তাই এখানে পা রাখতেই এয়ারপোর্টটাকে কেমন চেনা মনে হচ্ছিল। টার্মিনাল ৩ ধরে বেরিয়ে প্রি-পেইড ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিলাম মহিফালপুরের উদ্দেশে। সঙ্গে ফখরুল আলম স্যার ও সেলিনা হোসেন। এসি ট্যাক্সি। তবু দিল্লির বাতাস গায়ে মাখার জন্য এসি বন্ধ করে জানালার গ্লাস নামিয়ে দিলাম। অমনি কালো ধোঁয়া গাড়ির ভেতর কেমন আচ্ছন্ন করে নিয়েছে আমাদের। নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। ফখরুল স্যার বলেন, ‘দিল্লির আবহাওয়া এই সময়ে খুব খারাপ থাকে। যতটুকু পারো এর থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখো।’ কালো ধোঁয়া শরীরে মেখে মহিফালপুর হোটেল কিয়ানে এসে থামল ট্যাক্সি।

রাতের ডিনারে বাংলাদেশ
রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ডিনারে গিয়ে প্রথমেই একটা ধাক্কা খেলাম। ভুল করে আফগান রেস্তোরাঁয় চলে আসিনি তো! সৈয়দ মুজতবা আলী আর ইউটিউবের কল্যাণে পশতু ভাষায় ভাববিনিময় শিখেছি। কিন্তু খাবার টেবিলে আফগানরা যেই পশতু বলছেন, তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে আসছে না। দুই টেবিল এগিয়ে যেতেই দেখি, নেপালি টুপি আর ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা নেপালিরা মুখ ডুবিয়ে খাচ্ছেন। পাশ কাটিয়ে সামনে গিয়ে দেখি ভুটানিদের। কিছুটা খেই হারিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তখনই পিঠে হাত রাখলেন আসিফ ভাই। বিজ্ঞান বক্তা আসিফ। নির্ভরতার হাত যেন! খাবার নিয়ে বসলাম আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে। একই টেবিলে মো. নূরুল হুদা, সেঁজুতি বড়ুয়া, জ্যোতির্ময় সেন, হানযালা হান ও সন্তোষ কুমার ঢালী। পাশের টেবিলে সেলিনা হোসেন, ফখরুল আলম, ঝর্ণা রহমান, আশরাফ জুয়েল। এর পাশের টেবিলেও চলছে বাংলায় আড্ডা। এখন আর অচেনা মনে হচ্ছে না পরিবেশটাকে।

রোদের আয় আয় ডাক
ডিনারের পর কখন যে রাত গড়িয়ে সকাল হলো, বুঝতেই পারিনি। ফের ভোর ছয়টায় ব্রেকফাস্টের তাড়া। একটু পরেই হোটেল থেকে বাস ছাড়বে ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের উদ্দেশে। বাস মিস করা যাবে না। আসিফ ভাইকে বললাম, ‘আপনার পাশে একটা সিট রাইখেন।’ তিনি পাশের সিটটাই রাখলেন। বাসে বসে দিল্লির সূর্য দেখলাম। জানালার গ্লাস গলিয়ে রোদ তার মায়াবী পরশ বুলিয়ে দিল শরীরে। অন্য রকম এক ভালো লাগা খেলা করে মনে। বাস ছুটে আর রোদ আয় আয় ডাকে। রোদের ডাকে সাড়া দিয়ে একসময় পৌঁছে যাই ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে। বিশাল জায়গা। নতুন দিল্লি এমনিতেই একটু খোলামেলা। তার ওপর স্থানটা একটু বেশিই যেন প্রশস্ত। কাঁঠালচাপা, বাগানবিলাস আর নাম না জানা ফুলের রাজ্যে শুরু হলো ৫৭তম দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য উৎসব।

মানবতাবাদ, শান্তি ও সহমর্মিতার সুর
শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও যোগাযোগের সূত্রে ভাবের আদান-প্রদানের পাশাপাশি সাহিত্য ও সংস্কৃতির হাত ধরে মানবতাবাদ, শান্তি ও সহমর্মিতার আকাঙ্ক্ষাই ছিল এবারের উৎসবের মহৃল সুর। বিগত তিন দশকে ‘ফোসয়াল’ সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ৫৬টি সম্মেলন অনুষ্ঠান ছাড়াও দক্ষিণ এশীয় কথাসাহিত্যিক ও কবিদের লেখা অনুবাদ করে পঞ্চাশের অধিক মানসম্পন্ন গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এ বছর দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য উৎসবে যোগ দিয়েছেন সার্কভুক্ত দেশের প্রায় ১৫০ জন কবি, কথাশিল্পী, অনুবাদক, সাংবাদিক ও সাহিত্য সমালোচক। শিশুসাহিত্য নিয়ে ‘ডে অব কিংফিশার’ শিরোনামে একটি গদ্য উপস্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল আমাকে।

বাংলাদেশের অর্জন
সার্ক সাহিত্য পদক ২০১৯ পেয়েছেন বাংলাদেশের কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, মালদ্বীপের আশরাফ আলী ও নেপালের কবি বিস্মা উপরেতি। এর আগে বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন শামসুর রাহমান, সেলিনা হোসেন ও ফখরুল আলম।

এক চিলতে আকাশ
তিন দিনব্যাপী এই সার্ক সাহিত্য সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা ও সার্ক সাহিত্য সম্মেলন আয়োজক কমিটির বর্তমান সভাপতি খ্যাতনামা ভারতীয় কথাসাহিত্যিক অজিত কৌর। তিনি ১৯৮৬ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার এবং ২০০৬ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার লাভ করেন। আমার গদ্য উপস্থাপনের পর পরম স্নেহে তিনি বুকে টেনে নিয়ে কপালে আদর দিয়ে দিলেন। এত্ত এত্ত মানুষের ভিড়ে নিজেকে যেন এক চিলতে আকাশের নিচে আবিষ্কার করলাম।