বাদামওয়ালা

বাদামওয়ালা। ছবি: সংগ্রহীত
বাদামওয়ালা। ছবি: সংগ্রহীত


রোদের তপ্ততায় পুড়ে, বৃষ্টির কাদাপানিতে ভিজে, ঝোড়ো হাওয়ার ধুলাতে ধূসরিত হয়ে, ডালিভর্তি বাদাম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, আমি এক কিশোর, আমার নাম ‘বাদামওয়ালা’।
জন্ম হয়েছে কোন বস্তিতে তা জানি না। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখছি দুই বেলা দুই মুঠো ভাতের জন্য ভয়ানক হাহাকার। এই নগরী লোকে লোকারণ্য। রাস্তাগুলোর পাশে আমার ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকি নগরীর বিভিন্ন রাস্তায়।
কখনো পেটে জ্বলে ক্ষুধার আগুন, কখনোবা চোখে জ্বলে স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার ফাগুন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকি রাস্তার ধারে, বাদামের ডালি নিয়ে। কত রংবেরঙের মানুষ দেখি ঢাকা শহরে। কেউ পকেট মারে, কেউ চুরি করে, কেউ করে ক্ষুধার রাজ্যে বসবাস।
সকালবেলা বাদাম বিক্রি করি স্কুলের সামনে। আমার খুব ইচ্ছা করে স্কুলে পড়তে। কী সুন্দর করে ছেলেমেয়েরা স্কুলের ড্রেস পরে, সবার একসঙ্গে ছুটি হয়। একই রঙের জামা পরে। আমারও খুব ইচ্ছা করে বাদাম বিক্রি ছেড়ে স্কুলে লেখাপড়া করতে।
আমার খুব ইচ্ছা করে মা-বাবার হাত ধরে খোলা আকাশের নিচে হাঁটতে। কিন্তু আমি তো জানিই না কে আমার মা, কে আবার বাবা! আমি শুধু জানি, আমার পেট ভরা ক্ষুধা, আমাকে ঘরভাড়া দিতে হবে, বুড়ো নানির জন্য খাবার কিনতে হবে, আমার যে কেউ নেই। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখছি এই বুড়ো মানুষটা আমাকে বুকে নিয়ে বড় করেছে।
আমাকে নাকি আমার মা পলিথিনে করে (আমার জন্মের পর) রাস্তার পাশে ড্রেনে ফেলে দিয়েছিল। যদি ড্রেনে ফেলতেই হবে, তবে কেন আমায় জন্ম দিয়েছিলে? যদি আমাকে ছেড়ে চলে যেতেই হবে, তবে কেন রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলে?
বাদামওয়ালা হতে ভালো লাগে না, মা। বাদামের ডালি নিয়ে রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে আসে দুই পা।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠি। স্কুল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকি। আর দুই চোখ ভরে দেখি, স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য তাদের মায়েরা রাস্তার ধারে বসে থাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি রোদে পুড়তে থাকি।
আমারও বেড়াতে ইচ্ছা করে, স্কুলে পড়তে ইচ্ছা করে। আমারও পরিষ্কার জামা পড়তে ইচ্ছা করে। মজার খাবার খেতে ইচ্ছা করে। দলে দলে মানুষ কিনতে আসে বিভিন্ন রকম জিনিস। আমি এক নীরব বোবা দর্শক। সবার আনন্দ দেখে নীরবে ফেলি চোখের পানি।
আমারও পেতে ইচ্ছা করে ভালো খাবার, সুন্দর পোশাক। মাঝেমধ্যে মনে হয়, বাদাম আর বিক্রি করব না। কিন্তু কী করব আমি? কীভাবে চলবে আমার জীবন?
মাঝেমধ্যে খুব ইচ্ছা হয় একটু বসি রাস্তার ধারে। বসে থাকি বাদামের ডালি নিয়ে। কিন্তু বসে বাদাম বিক্রি করলে বেশি টাকা দিতে হয় রাস্তার নেতাদের।
দাঁড়িয়ে বাদাম বিক্রি করলে দিতে হয় কম টাকার ঘুষ। আর বসে বাদাম বিক্রি করলে গুনতে হয় অনেক বেশি টাকা। ভ্যান গাড়ি থাকলে, চাঁদার পাল্লা হয় আরও বেশি। তারা তো রাস্তার নেতা নয়, তারা আমার মতো গরিবের কাছ থেকে চাঁদা নেয়। তারা আমার থেকেও বেশি ভিখারি।
রোদ আমাদের পোড়াতেই থাকে, বৃষ্টি আমাদের ভাঙা ঘরটাকে আরও বেশি ভিজিয়ে দেয়, ঝোড়ো হাওয়া আমাদের স্বপ্নগুলোকে করে তোলে আরও বেশি ধুলোয় ধূসরিত।
আমার নাম ‘বাদামওয়ালা’। আমি বাঁচতে চাই, মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই।