হাতুড়ি

বাপ রে বাপ! আরিক এত দুষ্টু যে যে–কেউ তার ওপর সহজেই বিরক্ত হয়ে যায়। আরিকের জন্য তাদের বাসায় আজকাল মেহমান আসাও বন্ধ হয়ে গেছে। তেমন কেউ আসতে চান না। শুধু কি তা–ই—তাকে নিয়ে তার মা–বাবাও কোথাও যান না। কিন্তু আরিকের খুব বেড়ানোর শখ। মাঝেমধ্যেই তাকে বেড়াতে নিয়ে যেতে হয়।
ওর বয়স সাত বছর।
রোববার দিন আরিকের ছোট খালামণি এসেছে বাসায়। ছোট খালু এই প্রথম এল। পনেরো দিন আগেই তাদের বিয়ে হয়েছে।
কোথা দিয়ে কখন যে ছোট খালুর দামি মোবাইলটা নিয়ে গেল কেউ টেরই পায়‌নি।
কিছুক্ষণ পর সে দৌড়ে এসে বলল, বাবা, খালুর মোবাইলে একটা কল দাও দেখি।
বাবা বললেন, কল দেব কেন? খালু তো এখানেই বসে আছে।
খালুর ডান হাতটা চলে গেল তার পাঞ্জাবির পকেটে।
কই, মোবাইল তো নেই। ইস মোবাইলটা মনে হয় ফেলে এসেছি উবারে। খালু বললেন।
ছোট খালা বললেন, আমি তখনই বলেছিলাম, মোবাইল পাঞ্জাবির পকেটে রেখো না।
আরিক ড্রয়িংরুমের সামনে দাঁড়িয়ে হাসছিল। এর মধ্যেই বাবা একটা কল দিলেন। আর ওমনি সে দৌড়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল। আবার কিছুক্ষণ পর চলেও এল।
সে বলল, ছোট খালু আমার সঙ্গে আসো।
বাবা বললেন, রিং হচ্ছে।
আরিক বলে, বাবা প্লিজ, তুমি আরেকবার কল দাও।
ছোট খালুর সঙ্গে ছোট খালাও গেলেন। সঙ্গে আরিকের মা–ও। বাবা ড্রয়িংরুমে বসে কল দিলেন।
আরিক বলল, দেখেছ দেখেছ, মোবাইলটা কেমন মাছের মতো নড়াচড়া করছে! তারা তিনজনই বাথরুমে একটা ভরা বালতির দিতে ঝুঁকে আছে।
আরিক বালতির পানির মধ্যে মোবাইলটা ডুবিয়ে দিয়েছে।
ছোট খালু আগেই শুনেছিলেন আরিকের কথা। তিনি মিটিমিটি হাসলেন। কিন্তু ছোট খালার মুখটা কালো হয়ে গেল। আর লজ্জায় লাল হলো আরিকের মা–বাবার চেহারা।
তারা একটু পরে চলে গেলেন। হয়তো আরেকটু বসতেন। মেহমান যাওয়ার পর বাবা রাগে গর্জে উঠলেন। আলমারির ফাঁক থেকে একটা লোহার হাতুড়ি বের করলেন। সেটা উঁচু করে ধরলেন ছেলের দিকে।
বললেন, এটা চিনে রাখ। আবার যদি এমন করিস, মাথা ফাটিয়ে দেব।
হাতুড়ির দিকে তাকিয়ে আরিক হাসছে। হঠাৎ হাতুড়িটা একটা সাদা কবুতর হয়ে গেল। আরিক বলল, বাবা তাড়াতাড়ি ছেড়ে দাও ওটাকে। তোমার হাতে হাক্কা করে দেবে। বাবা তাড়াতাড়ি হাতের কবুতরটা ছেড়ে দিল। আর অমনি সেটা উড়তে লাগল সারা ঘরে। একবার ড্রয়িংরুমে যায়। একবার বেডরুমে যায়। একবার রান্নাঘরে যায়।
মা বললেন, তাড়াতাড়ি সব দরজা–জানালা খুলে দাও। ওটা বের হয়ে যাক। দরজা-জানালা খোলা হলো। কিন্তু কিছুতেই সে বাইরে বের হলো না।
অনেক রাতে ছোট খালুর ফোন। আরিকের মা ফোন ধরেছেন। খালু বললেন, আপু নিতু তো অজ্ঞান হয়ে গেছে। এখন কী করি?
অজ্ঞান, কেমন করে হলো?
বাসায় এসে ও ওর ভ্যানিটি ব্যাগ খুলেছে। আর অমনি সেটার ভেতর থেকে বের হয়ে এল কয়েকটা তেলাপোকা।
মা বললেন, তেলাপোকা? সর্বনাশ! ও তো তেলাপোকা ছোটবেলা থেকেই ভয় পায়।
আরিক খুশিতে লাফিয়ে উঠল। আম্মু, আমি মাত্র তিনটি তেলাপোকা ভরে দিয়েছিলাম খালামণির ভ্যানিটি ব্যাগে।
বাবা রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলেন। পাশের ঘর থেকে একটা স্কেল নিয়ে এলেন।
এই, হাত পাত।
আরিক বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আর অমনি তার হাতে একটি সাদা কবুতর এসে বসল।
আরিক বলল, এটাকে মেরো না, ব্যথা পাবে।
কবুতরটি উড়ে গিয়ে বসে জানালার গ্রিলে, যেখানে আগের কবুতরটি বসেছিল। পাশাপাশি বসে দুটোই বাকবাকুম শব্দ করতে লাগল।
মা–বাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কবুতর দুটির দিকে। আবার তাকায় ছেলের দিকে।
হঠাৎ আবার ফোন এল। ছোট খালুর ফোন, ছোট খালু বললেন, ভাইয়া আপনাদের আসতে হবে না। ওর জ্ঞান ফিরেছে, ভালো আছে।
পাশের ঘরে একাই ঘুমায় আরিক। সে ঘুমাতে চলে গেল।
মা বললেন, ওকে নিয়ে কী করি, বলো তো?
হোস্টেলে দিয়ে দাও। নিয়মের মধ্যে পড়লেই ঠিক হয়ে যাবে, বাবা বলেন।
পাশের ঘর থেকে আরিক দৌড়ে এল। আম্মু, আমি হোস্টেলে যাব না। মা জড়িয়ে ধরলেন আরিককে। বললেন, তোর আজ ও ঘরে শুতে হবে না। আমাদের কাছে থাক।
বাবা কবুতর দুটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবলেন, আরিকের মধ্যে এমন কী আছে যে এমন হচ্ছে। হাতুড়ি, স্কেল হয়ে গেল কবুতর।
আরিক বলে, দেখো বাবা, একটা কবুতর আরেকটা কবুতরের মাথা চুলকে দিচ্ছে।
মা–ও তাকালেন কবুতর দুটির দিকে। ভাবলেন, ওরা যেন কত দিনের পরিচিত।
সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলের জন্য তৈরি হলো আরিক। স্কুলে যাওযার সময় আরিক মা-বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা তো প্রতিদিনই ঝগড়া করো। সকালে ঘুম থেকে উঠেও ঝগড়া করো। আজ ঝগড়া করছ না যে?
মা–বাবা লজ্জা পেলেন যেন। বাবা আরিককে জড়িয়ে ধরে বললেন, না বাবা, আমরা আর ঝগড়া করব না।
হঠাৎ কবুতর দুটির পাখা ঝাপটানোর শব্দ পাওয়া গেল। ওরা তিনজনই সেদিকে দৌড়ে গেল। দেখল, কবুতর দুটি উড়ে যাচ্ছে।
আরিক বলল, ওদের বন্দি থাকতে ভালো লাগছিল না হয়তো।
আমারও বন্দী থাকতে ভালো লাগছে না।
মা বললেন, চলো না, আমরা দূরে কোথাও ঘুরে আসি।
বাবা বললেন, চলো। আজই এক্ষুনি। ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলি। মা বললেন, আরিক তাড়াতাড়ি স্কুলড্রেস খুলে ফেলো। চলো, তোমাকে অন্য জামা পরিয়ে দেই।
বাবা বললেন, তাড়াতাড়ি গোছগাছ করে নাও। দুদিনের থাকার প্রস্তুতি নিয়ে চলো।
আরিক তার লাল ব্যাগটায় নিজের জামা-কাপড় ভরতে লাগল। তার কী যে ভালো লাগছে আজ!
বাবা হাতুড়িটা একটি ব্যাগে ভরল। আরিক বলল, বাবা হাতুড়িটাও কি আমাদের সঙ্গে বেড়াতে যাবে? নাকি ওটা দিয়ে আমার হাড্ডিগুড্ডি ভেঙে ফেলবে?
বাবা হেসে বললেন, না, এটাকে কোনো জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসব।