কাকা পাখি

কাকা পাখি। দন্ত্যস রওশন
কাকা পাখি। দন্ত্যস রওশন


বিপুলদের বাড়ি। বাড়ির পিছনে বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের আশপাশ জুড়ে নানা রকমের গাছ। তারই একটি গাছে ঘুঘু পাখি বাসা বেঁধেছে। দুটো ডিমও পেড়েছে।
বিপুলদের গ্রামের নাম মাথাভাঙা। সেই গ্রামেরই দুটো দুষ্টু ছেলে মিলু ও আতা। দুজনই বেজায় দুষ্টু। তারা সারা দিন সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। কোথায় কোন গাছে ফল ধরেছে, কোথায় কোন গাছে কোন পাখি বাসা করেছে, সেসব খুঁজে বেড়ায়।
একদিন দুপুরবেলা। দুটো ঘুঘু পাখিই বাসা ছেড়ে খাবার খেতে গেছে। ঘণ্টাখানেক পরই তারা ফিরে এল। ফিরে এসেই তাদের মাথা খারাপ। দেখে বাসায় ডিম নেই। মা ঘুঘুটা ভীষণ কান্নাকাটি শুরু করে দিল।
বাবা পাখি বলল, ‘কাদঁলে কী হবে? একটা উপায় খুঁজতে হবে, ডিম দুটো কীভাবে পাওয়া যায়।’
মা পাখি কেঁদে কেঁদে বলল, ‘ও তো শুধু ডিম নয়। ডিমের ভেতর যে আমার দুটো বাচ্চা আছে। কালই দেখলাম নড়াচড়া করছিল।’
হঠাৎ একটা কাক এসে বসল আমগাছে। বাবা ঘুঘু বলল, ‘কাক ভাই, আমরা বাসায় এসে দেখি আমাদের দুটো বাচ্চাই নেই।’
কাক বলল, ‘বাচ্চা? বাচ্চা কোথায় পেলে? কালও তো দেখলাম দুটো ডিম। তখনো ডিম ফোটেনি।’
মা ঘুঘু বলল, ‘ওই একই কথা। কাক ভাই, তুমি তো ছোঁ মারতে পার। আমাদের ছানা দুটোকে যদি উদ্ধার করে দিতে!’
কাক বলল, ‘মুশকিলে ফেললে। কোথায় যাই এখন? কে নিয়েছে তোমাদের ডিম?’ এ কথা বলে কাক উড়ে চলে গেল। উড়তে উড়তে দেখে দুটো ছেলের হাতে দুটো ডিম। তারা বেশ আনন্দে হেঁটে যাচ্ছে।
একজন বলছে, ‘আমি জীবনে ঘুঘু পাখির ডিম খাইনি।’ আরেক জন বলল, ‘ডিম ভেজে খাওয়ার দরকার নেই। ডিম থেকে আমরা বাচ্চা ফোটাব। তারপর বাচ্চা পালব। আমার মেজ মামার একটা লোহার খাঁচা আছে।’
কাকটা শুনছিল সব কথা। সে বলল, দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। উড়ে গিয়ে দুজনের হাত থেকে ডিম দুটো ছোঁ মেরে নিয়ে গেল সে। তারপর উড়ে চলল ঘুঘুর বাসার দিকে।
অনেক উঁচুতে উড়ছিল একটি চিল। সে দেখতে পেল, কাকের মুখে দুটো ডিম। তার ভীষণ লোভ হলো। বলল, দেখাচ্ছি মজা।
অমনি সে ডিগবাজি খেতে খেতে কাকের ওপর হামলা করল। কাকের মুখ থেকে ছিনিয়ে নিল ডিম দুটো।
কাক বেচারা দুঃখে কা কা করতে লাগল। চিল ডিম নিয়ে বসল একটি শিমুলগাছের উঁচু ডালে।
ওই গাছের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল দুটো শকুন।
তাদের দুজনের চোখে পড়ল চিলের মুখে ডিম। চিল ডিম খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আর দেরি নয়। দুই শকুন হামলে পড়ল চিলের ওপর। আর যায় কোথায়! চিল ডিম ছেড়ে পালাল।
একজন বলল, ‘চলো, এক্ষুণি গিলে ফেলি।’
আরেক জন বলল, ‘না। এতে তো আমার ক্ষুধাই মিটবে না। তার চেয়ে বরং কোথাও রেখে দিই। ডিম ফুটে যখন বাচ্চা হবে, তখন খাব।’
প্রথম জন বলল, ‘না, বাচ্চা হলেই খাওয়া যাবে না। বাচ্চা বড় হলে খেতে হবে। তাহলে আমাদের দুজনের পেট ভরবে।’
সেই গাছে বসেই কাকটা শুনছিল শকুনদের কথা। সে বলল, ‘আহারে, তোমাদের কত কষ্ট। পেটে কত ক্ষুধা।’
শকুন কাকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাদের কষ্ট কেউ বোঝে না। শুধু তুমিই বুঝলে।’
কাক বলল, ‘পাখির কষ্ট পাখিকে বুঝতে হয়। শোনো শকুন ভাইয়া, কুসুম বিলে একটা কী যেন পশু মরে পড়ে আছে। অন্য শকুনদের দেখলাম, সেদিকে উড়ে যাচ্ছে। তোমরা যাচ্ছ না বুঝি?’
‘বল কী! আমরা তো এই খবরই পাইনি। শোনো কাক ভাইয়া, আমাদের ডিম দুটো দেখো। আমরা মাংস খেয়ে সন্ধ্যাবেলাতেই চলে আসব। যাই। তুমি আবার ডিম দুটো খেয়ে ফেলো না!’
কাক বলল, ‘ছি! ছি! তোমাদের ডিম আমি খেতে যাব কেন!’
শকুন দুটো উড়ে যাবার পরই কাক ডিম দুটো মুখে নিয়ে উড়ে গেল। উড়তে উড়তে ঘুঘুর বাসার কাছে পৌঁছে গেল। গিয়ে দেখে ঘুঘু দুটো পাশাপাশি বসে কান্নাকাটি করছে।
কাক বলল, ‘এই, তোমাদের কান্নাকাটির দিন শেষ। এই দেখো, তোমাদের বাচ্চা নিয়ে এসেছি।’
ঘুঘু দুটো খুব খুশি হলো। তবে মা ঘুঘুটা বলল, ‘দেখো, আমাদের বাসা নেই। আমাদের বাসার গাছটা কিছুক্ষণ আগেই কেটে ফেলেছে হরমুজ মিয়া।’
কাক বলল, ‘কী মুশকিল! বিপদের পর বিপদ! চলো আমার সঙ্গে। আমার বাসা খালি পড়ে আছে।’
বাবা ঘুঘু বলল, ‘কোথায় তোমার বাসা?’
‘পাশের গ্রামেই। একটা নারকেলগাছে। আমার বাচ্চারা এখন উড়তে শিখে গেছে। সেই বাসায় তোমরা বাচ্চা ফোটাবে।’
কিছুক্ষণ পরই পাশের গ্রামের একটি নারকেলগাছে গিয়ে বসল তারা। মা ঘুঘুটা বলল, ‘কাক ভাইয়া, কী বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ দেব!’
কাক বলল, ‘আমার খুব ভালো লাগছে, তোমাদের ডিম দুটো উদ্ধার করতে পেরেছি বলে। স্যরি, ডিম না, বাচ্চা দুটোকে উদ্ধার করতে পেরেছি।’
বাবা ঘুঘুটাও কাককে ধন্যবাদ দিল। কাক বলল, ‘তোমাদের ডিম ফুটে বাচ্চা হলে আমাকে খবর দিও। আমি এসে দেখে যাব।’
সাত দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা হলো। কাকটাকে খবর দেওয়া হলো। কাক খুশি হয়ে উড়ে এল। ছানা দুটি কাককে দেখে বলল, ‘মা কালো পাখিটার নাম কী?’
মা ঘুঘু বলল, ‘ছি! এমন করে বলতে নেই। উনি হচ্ছেন তোমাদের কাকা।’
ঘুঘুর বাচ্চা দুটো এখন কাকটাকে কাকা বলে ডাকে।