ইলিশ ট্যুর ঢাকা টু বরিশাল

সরষে ইলিশ। ছবি: শাকিব হাসান
সরষে ইলিশ। ছবি: শাকিব হাসান


পাঙাশ মাছ সেলফি তোলে রুপচাঁদার সঙ্গে।
আইড় মাছ আড়চোখে তাকিয়ে তা দেখে।
চিতল মাছের বিয়ে হবে
রুই মাছের সঙ্গে।
এই না শুনে রিঠা মাছ মিটি মিটি হাসে।
খবর পেয়ে বোয়াল মাছ ঘর ভরে নাচে।
ইলিশ মাছ প্রেম করে পূর্ণিমা রাতে

ইলিশের বাসরঘর ও ইলিশ ভোজ...
ইলিশের বাসরঘর
যেকোনো নারী-পুরুষের বাসররাতের একটা অন্য রকম ভাবনা থাকে। কবি–সাহিত্যিকেরাও এই কল্পনা থেকে বাদ যান না। আমাদের একজন প্রিয় কবি তাঁর প্রেমিকাকে বাসরঘরে নেওয়ার আগে এমন কিছু দুর্লভ বস্তু দিয়ে সাজিয়েছেন, যা এই মাটির পৃথিবীতে নেই। তিনি বিজলি জরির ফিতায় প্রেমিকার চুল বেঁধেছেন। জোছনার সঙ্গে চন্দন মিশিয়ে তাঁর গায়ে মেখেছেন। কবি রামধনু হতে লাল রং এনেছেন। এই রং দিয়ে আলতা বানিয়েছেন। সেই আলতা তাঁর প্রিয় মানসীর পায়ে পরিয়েছেন। শেষে কবি তাঁর প্রিয়াকে বাসরঘরে এনে বললেন,
‘আমার গানের সাত সুর দিয়া
তোমার বাসর রচিব প্রিয়া।
তোমারে ঘিরিয়া গাহিবে আমার কবিতার বুলবুল।’
বাসরঘর নিয়ে কবির এমন বিমূর্ত ভাবনা। সাধারণ নারী-পুরুষের ভাবনা হয়তো কবির মতো হবে না। কিন্তু বাসর নিয়ে তার আবেগ, অনুভূতি ও কল্পনার কোনো সীমা নেই। বাসররাতের জন্য নতুন খাট, বালিশ, বিছানা থাকে; থাকে একটা স্নিগ্ধ আলো-আঁধারি পরিবেশ। কখনো চিরলপাতার ফাঁক গলে ঘরে আসে জোছনা। বাজতে থাকে মিষ্টি একটা সানাইয়ের সুর। বিভিন্ন রঙিন ফুলের সমাহারে এ ঘর হয়ে ওঠে আরও স্বপ্নময়।
ইলিশের প্রেম-ভালোবাসাও হয় এমন একটি রোমান্টিক পরিবেশে। যেখানে কবির ভাবনা ও সাধারণ মানুষের ভাবনা দু-ই মিলে যায়। ইলিশ একটি সম্ভ্রান্ত বংশের মাছ! এরা প্রচণ্ড আভিজাত্য ও মানসম্মান নিয়ে বাঁচে। এদের নাক উঁচু। অন্যান্য প্রাণী সুযোগ পেলেই যেখানে-সেখানে অশোভন কাজগুলো করে ফেলে। ইলিশ মোটেই সেটা করে না। দিগন্ত প্লাবিত বিস্তীর্ণ সমুদ্রে এদের বাস। কিন্তু প্রেমের জন্য কল্পনা করে অন্য রকম, একটি নান্দনিক পরিবেশ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ঢালচর, মৌলভীরচর, কালিরচর, মনপুরা, আন্ধারমানিক, লতাচাপলি, পায়রা বন্দর এমন কিছু জলাধার আছে। এর আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি। বহু পথ পাড়ি দিয়ে প্রেমের জন্য এখানেই ছুটে আসে ইলিশ। এটিই ইলিশের বাসরঘর। এই বাসরঘরে এরা কয়েক মাস থাকে। আনন্দ–উৎসবের মধ্যে স্বপ্নের মতো কিছুদিন অতিবাহিত করে।
এদের আগমনের প্রিয় সময় আশ্বিন-কার্তিক মাস। সবাই প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী। এ সময় ইলিশেরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ থকে। চলতে থাকে কঠিন স্রোতের বিপরীতে। স্রোতের বিপরীতে চলার সময় এদের হৃদয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়। এটি প্রেম-ভালোবাসার উত্তেজনা। প্রতিমুহূর্তে একে অপরকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় বিভোর থাকে।
ইলিশ একা চলে না। ঝাঁকে চলে। তাই সব সময় এদের মধ্যে একটা প্রেম প্রেম ভাব থাকে। তবে জমে ওঠার মতো প্রেম হয় কেবল আশ্বিন-কার্তিক মাসেই। এ সময় রাতের আকাশে থাকে অপরূপ পূর্ণিমার চাঁদ। ইলিশের চরম প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর শ্রেষ্ঠ সময় এটি। জোছনাস্নাত মায়াবী নীলাকাশ। আকাশের গায়ে অজস্র তারার ঝিকিমিকি। নিঝুম রাত। ভরা পূর্ণিমার চাঁদ কুয়াশার চাদরের মতো নদীর পানিতে ঢেলে দেয় জোছনা। সবকিছু মিলে বাসরঘর ভীষণ স্বপ্নিল হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে নারী ও পুরুষ ইলিশের মাখামাখি, চলতে থাকে প্রণয় রোমান্স। এমন একটি সময়ের জন্য প্রেমিক-প্রেমিকাদের অপেক্ষা করতে হয় এক বছর।
নারী-পুরুষ উভয় ইলিশের মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত থাকে একটা স্পর্শকাতর রেখা। একে ল্যাটারাল লাইন বা পার্শ্বরেখাও বলে। এই স্পর্শকাতর রেখায় বারবার ঘর্ষণ দিয়ে দিয়ে শুরু হয় ইলিশের মিলনপর্ব। ঘর্ষণের জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে প্রেমিক-প্রেমিকা একান্ত কাছাকাছি আসে। তখন উভয়ই তাদের পার্শ্বরেখা দ্বারা একে অপরকে বারবার ঘর্ষণ দেয়। এভাবে উত্তেজনার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে। ফলে মা ইলিশ পানিতে ডিম ছাড়তে থাকে আর পুরুষ ইলিশ ছাড়তে থাকে রেণু। পানির নিচে স্রোতের তীব্র টান, ঝাঁকে ঝাঁকে মা ও পুরুষ ইলিশের দাপাদাপি, ঘোলা পানি, পুংরেণু, মা মাছের ডিম, সব মিলে এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি হয়। এ অবস্থায় মা ইলিশের ডিম পুংরেণুর সঙ্গে নিষিক্ত হয়ে জন্ম নেয় লাখ লাখ ইলিশ।

ইলিশ ভোজ
রওশন ভাই বললেন, ‘এই ইলিশের স্বাদ অনেক দিন মুখে থাকবে।’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সৈয়দ দুলাল ভাই ঘোষণা করলেন, ‘আজকের ইলিশের স্বাদ এখনই সবাই ভুলে যান। কাল দুপুরে আমার অফিসে ইলিশ ভোজ।’ ইলিশ কিছুটা দুর্লভ ও দামি মাছ। অধিকাংশ ক্রেতা এর দাম শুনলে নিরাপদ দূরত্বে চলে যান। বিক্রেতা যতই বলুক, ‘ভাই, না নেন, দামটা অন্তত বলে যান।’ সে যেন কিছুই শোনে না। নিরাপদ দূরে গিয়ে শেষবারের মতো ইলিশের দিকে ফিরে তাকান। ছোট্ট একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়েন। হায়রে ইলিশ! সেই ইলিশের আবার ভোজ। শুনেই একধরনের শিহরণ জাগে। অনেক ধরনের ভোজে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছে। কিন্তু কোনো ভোজের শিরোনাম ‘ইলিশ ভোজ’ এই প্রথম, হয়তো শেষও। বরিশাল বন্ধু উৎসব। ঢাকা থেকে যাচ্ছি কয়েকজন। মাইক্রোতে বসে প্রেম-ভালোবাসা, শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, কত ধরনের আলোচনা। হাসি, আড্ডায় পেছনে ফেলে এসেছি অনেকটা পথ। হঠাৎ মোহিত কামাল ভাই বললেন, এই ট্যুরের একটা নাম দেওয়া দরকার। রওশন ভাই বললেন, ‘আমরা সবাই ভাই ভাই, তাই এটা হবে ব্রাদার্স ট্যুর।’ মাহমুদুজ্জামান বাবু ভাই বললেন, মামু, খালু এর মধ্যে একটা স্বজনপ্রীতির গন্ধ আছে। এটা হবে জীবনানন্দ ট্যুর। ইমদাদুল হক মিলন ভাই বললেন, এটা হবে ‘ইলিশ’ ট্যুর। হো হো করে সবাই হেসে উঠলাম। নতুন করে শুরু হলো ইলিশ ট্যুরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা।

পর্ব-২
বন্ধুসভার ভ্রমণে একধরনের বৈচিত্র্য থাকে। যাত্রাপথে প্রতি জেলার বন্ধুরা অভ্যর্থনা জানায়। লাঞ্চ করলাম ফরিদপুর বন্ধুসভার সঙ্গে। মেনুতে ইলিশ। আহ! কী আনন্দ। মিলন ভাইয়ের উচ্ছ্বাসটা ছিল বেশি। কারণ, ইলিশের ভাবনাটা তাঁর মাথা থেকে এসেছিল। বিকেলে বরিশাল পৌঁছে হোটেল এথিনায় উঠলাম। বন্ধুসভার উৎসবগুলো খুব আনন্দঘন হয়। থাকে বিভিন্ন ধরনের নাচ, গান, কৌতুক, আবৃত্তি, তর্কবিতর্ক আরও কত–কী! বৈচিত্র্যে ভরা একটি দিনের জন্য অপেক্ষা। অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়ে রওশন ভাই এখানকার বন্ধুদের সঙ্গে বসলেন। সভা শেষ হওয়ার আগেই আমার আর মোহিত ভাইয়ের প্রস্থান। ইলিশের খোঁজে বেরিয়ে পড়া।
টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। বাজারে ঘুরে ইলিশ দেখছি। ইলিশ ট্যুরে ইলিশ খেতেই হবে। কিন্তু খুব বেশি বড় ইলিশ দেখছি না। একদিন কে যেন একজন বলেছিলেন, মাছের রাজা ইলিশ। মানুষের রাজা পুলিশ। তাহলে কি রাজায় রাজায় কোনো দ্বন্দ্ব হলো? বিক্রেতাদের আগ্রহ দেখে ভালো লাগছে। এইটা, ওইটা নেন বলে ডাকাডাকি করছে। মোহিত ভাই বললেন, ‘ওরা আমাদের একটু ভারী ক্রেতা মনে করছে। মানে, আমাদের কি ওজন বেশি? না। তা না। মনে করছে আমরা হয়তো দামি ক্রেতা। যা ইচ্ছে মনে করুক। কিন্তু বড় ইলিশ ছাড়া নেব না। বেশি দাম দেব না।’
কিছুক্ষণ পর একটা বড় ইলিশ দেখলাম। কেনার জন্য কথাবার্তা প্রায় শেষ, এমন সময় দেখলাম এর এক চোখ কানা। মোহিত ভাইকে বললাম এমনিতে চোখে একটু কম দেখি। আবার কানা ইলিশ নেব। মোহিত ভাইও বললেন, ‘থাক। ইদানীং আমারও চোখ জ্বালাপোড়া করে।’ ইলিশটি না নিতে পেরে উভয়ের মন খারাপ হলো। মোহিত ভাইকে বললাম, মন খারাপ করে লাভ নেই। মানুষের জীবনে সব সময়ে দুর্লভ সুযোগ আসে না। এই গ্রহে বোধ হয় আমরাই প্রথম সৌভাগ্যবান, যাদের কানা ইলিশ দেখার সুযোগ হলো।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। এটা নাকি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। কিন্তু ইলিশ কোথায়? একজন বলল কাল বড় ইলিশ আসবে।
মনে পড়ল, ছোটবেলার কথা। বাবা রাজনীতি করতেন। প্রায়ই কিছুদিনের জন্য উধাও হয়ে যেতেন। কিন্তু বাড়ি ফিরতেন অনেকগুলো বড় ইলিশ নিয়ে। তখন সেকি আনন্দ আমাদের! মনে হতো বাবা আরও বেশি করে হারিয়ে যান না কেন। ইলিশ দেখা ও খাওয়া দুটোই সমান আনন্দের। অর্থাৎ ৫০ ভাগ, ৫০ ভাগ। এই মহান ইলিশ আজ আর পাব না বলে ধরে নিলাম। মোহিত ভাইকে বললাম, কোনো কিছুর বিরহে মানুষ কবি হয়। আমরা কি এমন কিছু হতে পারি? তোমার যা ইচ্ছে হও। একটা ছড়া বলি? দেখেন তো মনে করতে পারেন কি না কোথায় শুনেছেন কি না?
বরিশাল, চাঁদপুর মোহনার খাড়ি
পদ্মা, মেঘনা ইলিশের বাড়ি
রুই মাছ, কাতল মাছ, ইলবিল ঝাঁ
তাড়াতাড়ি বাজারে ইলিশ এসে যা।
কোথায় শুনেছেন? শোনার তো প্রশ্নই আসে না। নিশ্চিত করে বলতে পারি জগতে এমন ছাড়া দ্বিতীয়টি আর নেই। কারণ এটা তোমার সৃষ্টি। বরিশালে এসে ইলিশ না পেয়ে এই আবোলতাবোল ভাবনা মাথায় ভর করেছে।
আচ্ছা আশফাক, খাড়ি, বাড়ি, ইলবিল ঝাঁ এসবের অর্থ কী? মোহিত ভাই, যেগুলোর অর্থ নেই সেগুলোই অমর সৃষ্টি। অর্থ থাকলে তো সব শেষ। খালি চোখে আপনি এর অর্থ বুঝবেন না। সরকার কীভাবে দেশ চালায়, এটা কি মানুষ বোঝে? বুঝলেই তো জারিজুরি শেষ। ধরে নেন এ এক অমর ছড়া। ধরে নিলাম। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের অমর ছড়া আর না করলে ভালো হয়। ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই মোহিত ভাই।

পৃথিবী নামক এই গ্রহে এমন কিছু নারী-পুরুষ আছে প্রথম দেখাতেই মানুষ যাদের প্রেমে পড়ে যায়। এই ইলিশটাও এমন যে প্রথম দেখাতে চোখ বন্ধ করে এর প্রেমে পড়া যায়।
এই ইলিশটা থেকে অন্য রকম ঘ্রাণ আসছে। বিশ্বে ইলিশ এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। মাছগোষ্ঠীর আর কারও পক্ষে এই স্থান দখল করা সম্ভব না। তাই ইলিশ একটু বাড়তি সম্মান পেতেই পারে। ওনাকে একটি ঝাঁকার মাঝখানে রাখা হয়েছে। ঝাঁকার এক পাশ দিয়ে ওনার মাথা অন্য পাশ দিয়ে লেজ বেরিয়ে গেছে। মোহিত ভাই বললেন, এই সেই সবেধন নীলমণি, সম্ভবত এনার জন্যই আমাদের এত অপেক্ষা। মোহিত ভাই হাতখোলা মানুষ। দাম একটু বেশিই দিলেন। আমিও ইলিশের সম্মানের কথা ভেবে কিছু বললাম না।
এখানকার প্রতিনিধি মারুফ ভাই রাতে খাওয়াবেন। ইলিশটা তাঁর বাসায় নেওয়া হলো।

পর্ব-৩
খাবার টেবিলে শুধু ইলিশ নয়, বিভিন্ন প্রকার মাংস, ভাজি, ভর্তায় টেবিল ভরা। আমি ছাড়া সবাই একটু বেশি ভদ্রলোক। একটু খায়, খায় না। আবার কোনো কোনো খাবার নিয়ে গবেষণা করে, খাবে কি খাবে না। শরীর জ্বলতে থাকে। আরে ভাই সুকান্ত বলেছেন, ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ ওরে ধরতে পারলে ওটাও খাও। অনেক বছর আগের কথা। সে কথা আজও মনে পড়ে। বন্ধুরা জিজ্ঞেস করেছিল জীবনের লক্ষ্য কী। কোনো কিছু না ভেবেই বলেছিলাম, খাওয়া। এখনো তারা দেখা হলে বলে ‘লক্ষ্যের অবস্থা কী।’ বলি আগের মতোই। সেখানে খাবার নিয়ে গবেষণার কী আছে? যদি বস্তুটি খাবার হয়। চোখ বন্ধ করে খেয়ে যাও। আমার এক কোরিয়ান বন্ধু ছিল, কথা প্রসঙ্গে একদিন বলল তারা ইট, কাঠ, মাটি, পাথর ছাড়া সব খায়। এটাই তো হওয়া উচিত। খাওয়ার টেবিলে একমাত্র আমিই দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করছি।
প্রত্যেকের প্লেটে ডোবা তেলে ভাজা ইলিশ। গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। সবার প্লেটে এক পিস করে করে দেওয়া হলো। পরিবেশনকারী ইলিশ হাতে অপেক্ষা করছে, যদি কেউ আরও নিতে চায়। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম প্রায় কেউ এক পিসের বেশি নিল না। ইলিশকে ‘না’ বলার জন্য একটা শক্ত বুকের পাটা দরকার। একমাত্র আমার ছাড়া সেটা সবার আছে দেখে ভালোই লাগল। আমাকে দিতে চাইলে হ্যাঁ-না কিছু বলি না। কিছু না বলার অর্থ হলো দিলেই ভালো হয়। পরিবেশনকারী দিতে থাকে। মাঝে মাঝে চোখের দিকে তাকায়। আমিও তার চোখের দিকে তাকাই। অর্থাৎ সেও তাকালো, আমিও তাকালাম। কাটাকাটি গেল। থাকে শূন্য। সে আবার গোড়া থেকে দেওয়া শুরু করে। বাকি কাজ নিজ দায়িত্বে আমাকে শেষ করতে হয়।
খাওয়া শেষে রওশন ভাই বললেন এ ইলিশের স্বাদ ভোলা যাবে না। দুলাল ভাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ভুলতে যে হবে। কাল আমার অফিসে ইলিশ ভোজ। তিনি জেলে সম্প্রদায়ের কয়েকজনকে ফোন করে তাঁর অফিসে বড় ইলিশ পৌঁছে দিতে বললেন। গল্পে গল্পে আরও বেশি কিছু সময় কেটে গেল। তারপর হোটেলের উদ্দেশে চলে যাওয়া। ঘুম থেকে উঠতে হবে অনেক ভোরে। সূর্য ওঠার আগেই বিভিন্ন জেলার বন্ধুরা অনুষ্ঠানে আসা শুরু করবে। শোয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুম।
বরিশাল থেকে লঞ্চে ফিরছি। লঞ্চের পেছনে এক কর্নারে দাঁড়িয়ে আছি। ঝুপ করে পদ্মার পানিতে পড়ে গেলাম। টের পেল না কেউ। তলিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি চারদিকে লাখ লাখ ইলিশ উৎসব করছে। এদের একটা দল ভাসিয়ে রেখেছে আমাকে। ইলিশের পিঠে ভেসে ভেসে পূর্ণিমার জোছনা দেখছি। এত বড় ইলিশ কোনো দিন দেখিনি। কোনো কোনোটাকে ডলফিনের মতো মনে হলো। এরা ভাসিয়ে তীরে নিয়ে এসেছে। হঠাৎ কী একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।

পর্ব ৪
সকাল ৯টা থেকে অনুষ্ঠান শুরু। দুপুরে লাঞ্চের বিরতি। মোহিত ভাই বললেন, বন্ধুদের সঙ্গে খাওয়াটাই অনেক আনন্দের। দুলাল ভাই মিলন ভাইয়ের দীর্ঘদিনের বন্ধু। তাঁর বিশেষভাবে দাওয়াতের অনুরোধ ফিরিয়ে দেওয়া ছিল অসম্ভব। তাই অনুষ্ঠান থেকে দুলাল ভাইয়ের অফিসে চলে আসা। খেতে বসে একেবারে ভিন্ন রকম অনুভূতি হলো। এখানে ইলিশ ছাড়া আর কোনো পদ নেই। বড় গামলার মধ্যে মিসরের পিরামিডের মতো করে একটার পর একটা ইলিশ ভুনা সাজানো। বড় ইলিশের এমনিতেই বেশি স্বাদ। তার ওপর রান্নাও ভালো হয়েছে। ভুনা ইলিশের মিনি পিরামিড থেকে এক অপার্থিব ঘ্রাণ আসছে। খাওয়া শুরু হলো।
খাওয়ার সময় সাধারণত বিভিন্ন ধরনের গল্প হয়। কিন্তু আজ কোনো এক অজানা অথবা জানা কারণে কেউ কিছু বলছে না। মিলন ভাই কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। অন্যরা তাতে আগ্রহ দেখাল না। কারণ সবাই নিষ্ঠার শতভাগ উজাড় করে দিয়েছেন খাবারে। খুব অল্প ভাতের সঙ্গে একটার পর একটা ইলিশ ভুনা খেয়েই পেট ভরে গেল। প্রায় শুধু ইলিশ খেয়েই পেট ভরে গেল। মনে করার চেষ্টা করলাম শুধু ইলিশ খেয়ে পেট ভরার ইতিহাস অতীতে আছে কি না। এ চেষ্টায় ব্যর্থ হলাম। এই প্রথম বুঝলাম কিছু ব্যর্থতা মানুষকে আনন্দ দেয়।

পর্ব ৫
একটু বিশ্রাম নিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এর থেকে বেশি জরুরি বন্ধু উৎসবে যাওয়া। অনুষ্ঠান শেষে রাতে হোটেলে ফিরলাম। দুলাল ভাই আমাদের সঙ্গেই আছেন। কোনো একটা পূজা চলছে। তিনি পূজা দেখাতে এক বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখানে আরেক এলাহি কাণ্ড। তাঁরা বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি—ছানা, সন্দেশ, রসগোল্লা, দই, নাড়ু, লুচি, সবজিসহ অনেক প্রকার খাবারে টেবিল ভরে দিয়েছেন। কিন্তু দুপুরে ইলিশ খাওয়ার পর আর কিছু খাওয়ার রুচি বা ইচ্ছা কোনোটাই নেই। আবার এত ধরনের খাবার ফিরিয়ে দেওয়া যে কত কঠিন সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। মনের গহিন থেকে একটা সূক্ষ্ম বেদনা অনুভব করলাম। জীবনের প্রথম দিকে বইয়ে পড়েছিলাম ‘ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ’। কোথায় সুখ সে পরীক্ষার সামনে তেমনভাবে পড়া হয়নি। তবে ত্যাগে কত যে সুখ আজ টের পাচ্ছি। মোটেই হাসি আসছে না, তারপরও হাসি হাসি ভাব করে কথা বলতে হচ্ছে। অবশেষে এক বুক বেদনা নিয়ে হোটেলে এলাম।

পর্ব ৬
খুব ভোরে নাশতার পর্ব সেরে আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা। দুপুরে কোথায় খাওয়া যায় সেটা নিয়ে কথা হচ্ছে। কেউ বলল ফরিদপুর, কেউ বলল রাজবাড়ী, বাবু ভাই বললেন, ‘সাভার পর্যটনে খাব।’ পর্যটনে পৌঁছাতে প্রায় বেলা গড়িয়ে গেল। একটু ফ্রেশ হয়ে আলো-আঁধারিতে টেবিলে বসলাম। সবাই মেনু দেখাদেখি করছে। মোহিত ভাই বললেন, ‘মেনু ফাইনাল। আর কোনো দেখাদেখি নাই। মিলন ভাই ইলিশ দিয়ে ট্যুর শুরু করেছিল, ইলিশ দিয়েই ট্যুরের সমাপ্তি হবে।’ এ ঘোষণায় সবাই একযোগে হাততালি দিয়ে হো হো করে হেসে উঠলাম।