এক রাতের উদ্বিগ্নতা


দিঘি নিয়ে একটি দারুণ গল্প আছে। সে কথায় পরে আসছি। আমরা উঠেছি দিঘির পাড়ের একটি ডাকবাংলোয়। এখানকার একটি মিলনায়তনে দিনব্যাপী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের দিনটিও ছিল আর দশটি আনন্দঘন দিনের মতোই। স্নিগ্ধ সকাল। রৌদ্রময় দুপুর। মায়াবী বিকেল। কিন্তু কেউ ভাবতে পারেনি শেষটা যে এত নির্মম হবে।
অনুষ্ঠান শেষে গাড়িতে ফিরছি সবাই। আমাদের ফলো করছে একটি গাড়ি। একসময় আমরা ডাকবাংলোর পার্কিংয়ে ঢুকে গেলাম। ওই গাড়িটি গেট থেকে ফিরে গেল। মোহিত ও মিলন ভাই পুরো ঘটনাটি লক্ষ করেছেন। ডাকবাংলোয় উঠেই দুজনে প্যান্ট,শার্ট পরে রেডি। এখানে থাকবেন না।
থাকার সব চেষ্টা করে যদি কেউ ব্যর্থ হয়, কেবল তখনই এমন একটি জায়গা ছেড়ে যেতে চাইবে। রওশন ভাইও থেকে যেতে চান। বাবু ভাইকে বোঝা কঠিন। তিনি থাকবেন কি থাকবেন না, তাঁর মন ভালো কি খারাপ, তাঁকে দেখে বোঝার উপায় নেই। চেহারায় একধরনের দার্শনিক ভাব থাকে। দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেহেতু থাকবেন না, তাই আমাদেরও থাকা হবে না।
অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও কাজ হচ্ছে না। তাঁরা দুর্বৃত্তদের আক্রমণের আশঙ্কা করছেন। এখানে থাকার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ আমার। মোহিত ভাইকে বললাম, বিগ ব্যাং নামে একটি থিওরি আছে। এ থিওরিমতে ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন বছর আগে এক বিস্ফোরণ হয়েছিল। আর এ বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের যাত্রা। সেই থেকে পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, গ্যালাক্সি সবই চক্রাকারে ঘুরছে। এমনি করে জন্ম–মৃত্যুও একটা চক্র। এই চক্র শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা বেঁচে থাকব। পাশ থেকে কে যেন একটু হেসে উঠলেন। মোহিত ভাই বললেন, তামাশার সময় নয় আজ। মোহিত ভাইয়ের কথায় মনে পড়ল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সেই কবিতাটি—
প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য...।
আশফাক থামো তো। থেমে গেলাম। রওশন ভাই বললেন, হারিকেন নিজেকে আলো দেয়। টর্চ অন্যকে আলো দেয়। লেখক মিলন ও মোহিত ভাই একই সঙ্গে নিজে ও অন্যদের আলোকিত করছেন। এমন দুজন মানুষকে হারানোর ঝুঁকি নিতে পারি না। আবার বাবু ভাইয়ের কিছু হলে দেশ চিরকালের জন্য হারাবে একজন শিল্পীকে। সাধারণের মধ্যে কেবল আমি আর আপনি। রওশন ভাইকে বললাম, দেশের বন্ধুদের মনে নিরন্তর স্বপ্ন বুনে দেন আপনি। শুধু আমিই গুরুত্বহীন। জগতের সকল প্রাণী সুখে থাকলে সুখে থাকব। সকলের মঙ্গল হলে আমারও মঙ্গল হবে।
হুংকার দিয়ে উঠলেন মোহিত ভাই। কে বলেছে তুমি গুরুত্বহীন? আল্লাহ একটি পিঁপড়াও বিনা কারণে সৃষ্টি করেননি। তোমার–আমার সবার প্রয়োজন আছে বলেই এখানে এসেছি। আমি আর মিলন ভাই কেন এখানে থাকতে চাই না? ধারণা করছি, ওই গাড়িটি কোনো বাজে লোকদের। আমাদের গভীরভাবে ফলো করেছে। যেকোনো সময় বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এমন একটা জায়গায় থাকার কারও দশমিক এক ভাগ ইচ্ছে থাকাও উচিত নয়। এবার সবাই নড়েচড়ে বসলাম। রওশন ভাই একটু বেশি নড়লেন। তিনি দিনাজপুরের প্রতিনিধিকে জানালেন। প্রতিনিধি সঙ্গে সঙ্গেই থানায় ফোন করলেন। এখানের প্রায় সব প্রশাসন ঘটনা জেনে গেল। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে পুলিশ ডাকবাংলো ঘিরে ফেলল। এক অফিসার বললেন, ‘আপনারা এখানে থাকতে পারেন। কোনো অসুবিধা নেই। নিরাপত্তা দেব।’
আমরা কিছুটা স্বস্তি পেলাম। কিন্তু মিলন ও মোহিত ভাইয়ের অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল। বিজ্ঞানী নিউটন একসময় মনে করতেন, সবকিছুর অবস্থান এই প্রকৃতিতে। প্রকৃতির কোনো অনিশ্চয়তা নেই। তাই আমাদের ওপরও কোনো অনিশ্চয়তা নেই। নিউটনের ধারণা বা পুলিশের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কোনো কিছুর ওপরই আস্থা রাখতে পারছেন না দুজন লেখক। তাঁরা থাকবেন না তো থাকবেনই না।
কিছুক্ষণ পর আবার পুলিশের লোক বললেন, এখানে আপনাদের থাকা হবে না। ওপর থেকে সরিয়ে নেওয়ার আদেশ এসেছে।
তখনো জানি না কোথায় নেওয়া হবে। পুলিশের পক্ষ থেকে গাড়িতে উঠতে বলা হলো। গাড়িতে উঠে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শেষবারের মতো দিঘির চারদিকে তাকালাম।
কিন্তু কেন যেন এই প্রথম নিজেকে একটু অন্য রকম লাগছে। নিজেকে ভিআইপি মনে হচ্ছে। কখনো ভাবিনি আমাদের নিরাপত্তায় হুইসেল বাজিয়ে ছুটবে পুলিশের গাড়ি। আহ কী মজা! কেন প্রতিদিন এমন দিন হয় না! আমাদের জন্য পুলিশের আগ্রহ দেখে ভালো লাগছে। বুঝতে পারলাম ক্ষমতাধরেরা কেন ক্ষমতা ছাড়তে চান না। এ এক অপার আনন্দ, অপার শান্তি! পুলিশ যখন এভাবে পাহারা দেয়, তখন কেউ কাছে আসতে পারে না। বিশাল ক্ষমতাবান হয়ে যান সবাই।
আজ নিজেকে মনে হচ্ছে বাদশা।
কিন্তু ওই দিঘিটিও দারুণ মনোরম। কোনোভাবেই এটি ছেড়ে যেতে মন চায় না। কৌতূহলী মানুষের স্বপ্নের জায়গা এটি। দিঘির চারপাশ ঘিরে রয়েছে লাল মাটির ছোট টিলা। বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর। বড় বেলে পাথর দিয়ে নির্মিত বিশাল শানবাঁধানো ঘাট।
এর উত্তরে রয়েছে একটি পুরোনো ভাঙা ভবন। এ ভবনটি সবার কৌতূহল সৃষ্টি করে।
প্রায় চার শ প্রজাতির গোলাপ আছে এখানে। দিঘির চারপাশের রাস্তার দুই ধারে রয়েছে দেবদারু, ঝাউ ও ফুলের গাছ। অত্যন্ত ছায়াঘেরা স্নিগ্ধ একটি পরিবেশ। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ছোট ছোট নীলাকাশ।এই দিঘির পরিবেশ নির্মাণে প্রকৃতি অনেকটা সময় দিয়েছে বলে মনে হয়। দিঘি নিয়ে রয়েছে এক কিংবদন্তি।
সময়টা বেশ আগের। এটা প্রায় সতেরো শ শতাব্দীর কথা। এই অঞ্চলে এক রাজা ছিলেন। নাম প্রাণনাথ। তিনি ছিলেন সুশাসক। প্রজারা তাঁকে খুব পছন্দ করত। তাঁর ধনসম্পদ ছিল অনেক। কিন্তু মনে কোনো শান্তি ছিল না। কারণ, রাজার কোনো সন্তান নেই। অনেক সাধনার পর ঘর আলো করে এল এক সন্তান। তার নাম রাখা হলো রামনাথ।
যুবরাজ বড় হলেন। তখন দেশজুড়ে নেমে আসে কঠিন দুর্যোগ। শুরু হলো একটানা অনাবৃষ্টি, খরা। দীর্ঘদিনের অনাবৃষ্টি ও খরায় খাল-বিল, দিঘি-নালা শুকিয়ে গেল। মানুষ অনাহারে মরে যেতে লাগল। রাজ্যজুড়ে শুরু হলো পানির জন্য হাহাকার।
রাজা এক বিরাট দিঘি খনন করলেন। দিঘিতে পানি উঠল না। এ ঘটনায় ভীষণ কষ্ট পেলেন রাজা। হতাশায় আহার-নিদ্রা প্রায় ছেড়ে দিলেন। এরই মধ্যে একদিন স্বপ্নে পেলেন এক দৈববাণী। তাঁর একমাত্র পুত্র রামকে দিঘিতে বলি দিলে পানি উঠবে। এ কথা শুনে রাজ্যে নেমে আসে শোকের ছায়া।
অবশেষে দিঘির মাঝখানে নির্মাণ করা হলো একটি ছোট মন্দির। এরপর গ্রামে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে প্রজাদের জানিয়ে দেওয়া হলো, কাল ভোরে দিঘির বুকে পানি উঠবে। পরদিন ভোর না হতেই রাজবাড়ির সিংহদ্বার খুলে গেল। হাতির পিঠে চড়ে শুভ্র বসনে যুবরাজ যাত্রা শুরু করলেন দিঘির দিকে। দিঘির পাড়ে পৌঁছে রাম সিঁড়ি ধরে নেমে গেলেন মন্দিরে। সঙ্গে সঙ্গে এর তলদেশ থেকে অজস্র ধারায় পানি উঠতে লাগল। পানিতে ভরে গেল বিশাল দিঘি। সেই পানিতে ভেসে রইল রাজকুমারের সোনার মুকুট।
যুবরাজ রামের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে দিঘির নাম রাখা হলো রামসাগর।
ইশ! কেন দিঘিতে পানি উঠল না? কেন রাজাকে তাঁর একমাত্র সন্তান হারাতে হলো? রামই–বা কেন কোনো প্রশ্ন ছাড়াই নিজের মৃত্যুকে মেনে নিলেন? এসব ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে গেছি।
হঠাৎ প্রচণ্ড হুইসেলের শব্দে নিজেকে ফিরে পেলাম। অতঃপর রাতের নৈঃশব্দ্য ভেঙে পুলিশের কঠোর নিরাপত্তায় অন্যত্র চলে যাওয়া...।

সাংবাদিক ও সংগঠক