আমাদের হিরু কাকা যেদিন কবি হলো

যতদূর জানি আমাদের হিরু কাকা ম্যাট্রিক তিন বারের বার পাস করেছে।
রেজাল্টটা?
না না, তা হচ্ছে না! রেজাল্ট বলা যাবে না। রেজাল্ট শুনলে কাকেরও ইয়ে পাবে। তাই না শোনাই ভালো।
আমাদের হিরু কাকা এক্কেবারে একটা পচা! আমার বন্ধু শিমুলের কাকামনিটা কি স্মার্ট। চোখে সানগ্লাস দেয়। হাতে ঘড়ি পরে। পায়ে জুতা পরে। ধুর! আমার কাকামনিকে ভালো লাগে না! খাওয়া নেই সময়মতো, দাওয়া নেই সময়মতো, চুল কাটা নেই, ময়লা পোশাক পরে আউলাঝাউলা হয়ে বেড়ায়। কাঁধে আবার একটা ব্যাগও রাখে। সে নাকি কবি। যত্তসব ঢং!
কাকের বাসাটাও ভালো আছে, তবু আমার কাকার মাথার চুলগুলো ভালো নেই। আচ্ছা চুলগুলো ভালো করে কাটলে ক্ষতি কী, হুম?

কবিদের নাকি চুল কাটতে হয় না, তেল-শ্যাম্পু দিতে হয় না। যত্তসব আদিখ্যেতা দেখ হিরু কাকার কাছে।
আর পরে পাঞ্জাবি। এত ঢিলেঢালা পরার কি আছে! হিরু কাকার মতো আরও তিনজনকে ঢোকানো যাবে ওই পাঞ্জাবির ভেতর!
আর এসব কী হচ্ছে হিরু কাকা?
এত গরমের মধ্যেও তুমি চাদর গায়ে দিয়ে আছ!
আর ওসব পোশাকে কী বিদঘুটে গন্ধ রে বাবা!
- হিরু কাকা? তোমার এই ঢঙের পোশাক কত দিন পরিষ্কার কর না?
এই কথা শুনে হিরু কাকা আমার কাছে দৌড়ে আসে। তারপর আগ্রহ করে বলে, কেন? কোনো গন্ধটন্ধ পেলি নাকি?
- হুম!
হিরু কাকা হাতটা মুঠো করে বগল কাঁপিয়ে ইয়েস বলে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। এখানে আনন্দ পাওয়ার কী হলো বুঝলাম না।
- ওরে পাগলি, কবিরা উদাস হয়। তাই এরা কাপড় পরিষ্কার, রূপচর্চায় সময় দিতে পারে না। তাই এদের কাপড় দিয়ে গন্ধ বের হয়।
- হিরু কাকা...
হিরু কাকা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, এই দাঁড়া, এসব কা কা করবি না তো। কেমন জানি লাগে। মনে হয় কাক ডাকছে। তুই বরং আমাকে কবি বলে ডাকবি, বুঝলি?
হিরু কাকার কাণ্ডকিত্তি এখানেই শেষ নয়। যদিও হিরু কাকার চোখের সমস্যা নেই, তবুও সে মোটা ফ্রেমের চশমা পরে। কবিদের মোটা ফ্রেমের চশমা নাকি একটা ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে।
একদিন আমাদের হিরু কাকা আমাদের সবাইকে ডাকল। তন্নি, নাদিয়া, বিজয়, জিদান, সামি, শাকিব তোরা কইরে? তাড়াতাড়ি এদিকে আয়!
আমরা ভাবলাম যে হিরু কাকা নিশ্চয় কোনো কিছু এনেছে। এক্কেবাড়ে হইহুল্লোড় করে যেতে লাগলাম আমরা।
এই খেয়েছে রে! হিরু কাকা তার খয়েরি রঙের খাতাটা বের করে বলল,
আয় তোদের আমার লেখা একটা কবিতা শোনাই।
বিজয়টা বেশ দৌড়ে আসছিল। যখন শুনল যে হিরু কাকা তার লেখা কবিতা শোনাতে চায়, তো বিজয়টার পড়ে যাওয়ার জোগাড়। ভাগ্যিস জিদানটা ওখানে ছিল। টপাক করে হাত বাড়িয়ে ধরেছিল। যাক বাবা রক্ষে। নইলে তো কাল পত্রিকায় খবর হতো যে বিখ্যাত কবি হিরুর কবিতা শুনতে গিয়ে এক শিশুর ঠ্যাং মচকে গেছে...হা হা হা!

ঠাম্মি হিরু কাকাকে খুব বকে। ওই তো সেদিন বলল, ওসব ছাইপাঁশ বাদ দে, কিছু তো হতে পারলি না, অন্তত ব্যবসাটা ভালো করে কর।
তখন দেখি হিরু কাকা ভ্যা করে কেঁদে দেয়। কিরকম ছোট বাচ্চাদের মতো।
হিরু কাকার যখন মন খারাপ হয়, তখন আমি কাকার কবিতা শুনতে যাই। যখন কাকার কবিতা শুনতে চাই, তখন কাকা আনন্দ অনুভব করে। এটা একটা অভিনব পদ্ধতি হতে পারে হিরু কাকার মন ভালো করার জন্য।
আমি তখন হিরু কাকার কাছে গিয়ে বলি,
কবি কাকা তোমার লেখা একটা কবিতা শোনাও না! হিরু কাকা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ওরে ধাড়ি মেয়ে! আমাকে সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে বুঝি, হুম?
কী ব্যাপার! হিরু কাকা কী করে বুঝল যে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তার লেখা কবিতা শুনতে চেয়েছি।
১৫ বছর থেকে লন্ডনে থাকি। সেদিন ইন্টারনেটে দেখলাম আমাদের হিরু কাকার লেখা কবিতার বই নাকি এবার দেশসেরা পুরস্কার পেয়েছে। তাহলে সত্যি সত্যি হিরু কাকা জিতল!
বইটা যখন হাতে পেলাম, তখন তো দু চোখ চড়কগাছে ওঠার জোগাড়!
মানে! হিরু কাকা বইটা আমাকে...আমাকে উৎসর্গ করেছে!
সত্যি হিরু কাকা তুমি না পারও বটে!

সাহিত্য সম্পাদক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা