ভালোবাসি বলেই

আমার মেয়েটার অভিমান একটু বেশিই। ভালোবাসা বেশি হলে নাকি অভিমানও বেশি হয়। পাগলের মতো ভালোবাসে মেয়েটা আমাকে। আর সে জন্যই হয়তো আমার বেলায় ওর অভিমান উপচেপড়া। মাত্র আট বছর বয়স ওর। কিন্তু আমার প্রতি ওর শাসনগুলো ঠিক আমার ৬৮ বছরের মায়ের মতো। আমাকে বলা প্রতিটি কথা এমন করে বলে, যেন অনুরোধ নয়, আদেশ করে আমাকে। একটা আদেশ মানতে ব্যত্যয় হলেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। কথা বন্ধ হয়, খাওয়া বন্ধ হয়। গত মাসে বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল আমার। আমার বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে আমার আট বছরের এই মায়ের কড়া নির্দেশ ছিল, যেন লাল রঙের একটি জামা নিয়ে বাড়ি যাই। লাল রং বেশ পছন্দ ওর। আমার পছন্দের রং সবুজ। আমি বাড়িতে গেলেই ওর জমে থাকা একটা লাল জামা পরে আমাকে সবুজ রঙের একটা শার্ট পরতে বলে। আমি পরলে ও আমার কোলে উঠে বুকে মাথা রেখে বলে, বাবা, দেখ, আমরা বাংলাদেশ হয়েছি। সবুজের বুকে লাল। আমার ৬৮ বছরের মায়ের মতো কথা বলে মেয়েটা। আমার খুব ভালো লাগে। মেয়েটা দেশ বলতেই লাল–সবুজ বোঝে। বুকের মাঝে লাল–সবুজের চেতনা নিয়ে বেড়ে উঠছে সে। গত মাসে শেষ পর্যন্ত বাড়ি যাওয়া হয়নি আমার। এনজিওর চাকরি করি। চাইলেই নিজের মতো করে ছুটি নিতে পারি না। অনেক চেষ্টা করেও ছুটিটা যখন মেলাতে পারলাম না, তখন ওর জন্য কেনা লাল টুকটুকে জামাটা বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। শুনলাম, মেয়েটা আমার জামাটা ছুঁয়েও দেখেনি। অনেক চেষ্টা করেও মেয়েটার সঙ্গে কথাও বলতে পারিনি আমি। অভিমানী মেয়ে আমার। জেদ ধরে বসে আছে, আমি না গেলে আমার সঙ্গে কথাও বলবে না, আমার দেওয়া জামা ছুঁয়েও দেখবে না। ওর মা অনেক চেষ্টা করে একবার মেয়েটার কানে ফোনটা ধরিয়ে দেয়। আমি হাজারবার ক্ষমা চাওয়ার পর একটা শুধু কথা বলে মেয়েট, বাবা, তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না। আমি শেষ পর্যন্ত এ মাসে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করে অভিমান ভাঙাই মেয়েটার।
যে করেই হোক এ মাসে বাড়ি যেতে হবে আমার। না, শুধু মেয়ের জন্য নয়, নিজের জন্যও। কত দিন মেয়েটাকে দেখি না। ওকে দেখার জন্য বুকের ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে আছে। ম্যানেজার স্যারকে আগে থেকেই বলে রেখেছি। ম্যানেজার স্যারও এ মাসে ছুটে দেবেন বলে কথা দিয়েছেন। এই একটা মাস কিছুতেই কাটছে না। প্রতিদিন সকালে মেয়েটা ফোন দেয়, বলে, বাবা, এক মাস হতে আর কত দিন? আমি হিসাব করে বলি। ও শুনে খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। আমি ফোনের ওপার থেকেই ওর লাফিয়ে ওঠার শব্দ শুনতে পাই। আমার বুকটাও সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে ওঠে। কি যে আনন্দ। কি যে ভালো লাগা। এই ভালো লাগাটা আরও বেড়ে গেল ম্যানেজার স্যারের কথা শুনে। যখন বললেন, দেশের অবস্থা বিবেচনায় ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। এনজিওগুলোও এর আওতাধীন। খবরটা শুনতেই বুকের ভেতরটা আনন্দে যেন আরেকবার লাফিয়ে উঠল। মেয়েটাকে টানা ১০ দিন কাছে পাব আমি। এ যেন পৃথিবীর বুকে বাবার স্বর্গ পাওয়া।
ছুটিতে যাওয়ার আগে সরকারের নির্দেশিত সতর্কবার্তাগুলো আরও ভালো করে পড়ে নিলাম। আমি ও আমার পরিবারকে সুরক্ষায় রাখা আমার নৈতিক দায়িত্ব। গণজমায়েত এড়িয়ে চলা, গণপরিবহনে না ওঠা, কারও সঙ্গে হাত বা শরীর না লাগানো সতর্কবার্তাগুলো ভাবিয়ে তুলল আমায়। এসব এড়িয়ে বাড়ি যাব কীভাবে? ভাবনায় কোনো সমাধান পেলাম না। মনের ভেতর দ্বিধা নিয়েই কমলাপুর স্টেশনে গেলাম। স্টেশনের অবস্থা দেখে আমি যেন বাক্ হারিয়ে ফেললাম। এ যেন জনসমুদ্র। অথচ করোনার সংক্রমণ রোধে গণজমায়েত একেবারে নিষিদ্ধ। এই মানুষগুলো কি পরিবারের জন্য অকল্যাণ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে না? বিষয়টি ভাবতেই নিজের ওপরও রাগ লাগল। আমিও তো ওদের মতোই। এই ভিড়ে গাদাগাদি করে ট্রেনে যাওয়ার জন্যই তো আমিও স্টেশনে এসছি। ভাবতেই কেমন যেন লাগল। আমিও তো আমার কলিজার টুকরা কন্যাকে বিপদে ফেলতেই যাচ্ছি। ভাবনাগুলো যখন আমাকে দ্বিধান্বিত করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ফোনটা বেজে ওঠে আমার। আমি জানি ফোনটা আমার অভিমানী মেয়ের। আমি ফোনটা রিসিভ করি। ওপার থেকে সেই অস্থিও কণ্ঠ—বাবা, কখন আসছো? আমি উত্তর দিই, একটা কাজে আটকা পড়েছি মা। আজ যেতে পারছি না। ছোট্ট মেয়েটা আমার কী বুঝল জানি না, চুপ থাকল কিছুক্ষণ। এরপর শুধু বলল, বাবা, তুমি আমায় সত্যিই একটুও ভালোবাসো না। আমার বুকের পাঁজরগুলো তখন যেন এক এক করে ভাঙতে শুরু করল। ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে কেঁদে বলি, মারে, তোকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসি বলেই তোর কাছে গেলাম না। কিন্তু কিছুই বলা হলো না আমার। ফোনটা রেখে উল্টো হাঁটা শুরু করলাম আমি।