'প্রিয়াংকা'

প্রিয় প্রিয়াংকা,

ক্লাস সিক্সই তোমার সঙ্গে ঠোকাঠুকি ও আড়াআড়ি চোখে অনেক অজানা কথাই বলা হয়ে যেত। জয়নুল আবেদীনের রংতুলির আঁচড় লেপটে আছে তোমার মুখে। নাকি ঈশ্বরই নিজ হাতে এঁকেছেন তোমার প্রতিচ্ছবি! বুঝে ওঠার আগেই হারিয়ে যাই প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের মতোই তোমার চঞ্চল উদ্দীপনাময় হৃদয়ে। মাত্র কয়েক দিন পরেই আমাদের অনেক ভালো বোঝাপড়া হয়ে গেল। টিফিনের সময় যখন সবাই সবুজ ঘাসে মিশে যায়, আমরা তখন চোখের সমুদ্রে ডুবে যেতাম। অনেক কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ একদিন গোলাপের পাপড়ি মেশানো একটি চিঠি বইয়ের ভাঁজে খুঁজে পেলাম। ফরমালিনমুক্ত গোলাপের ঘ্রাণ বিমোহিত করেছে চারপাশ। নাকের ডগায় দীর্ঘশ্বাস নিয়েই প্রথম কোনো চিঠির ভাঁজ ভাঙতে ভাঙতে একটি কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। এ যেন প্রথম ভালোবাসা।
একটি নদ, নাম তার খোয়াই। দুই পারের মানুষকে আলাদা করে রাখলেও মনকে আলাদা করতে পারেনি। আষাঢ়–শ্রাবণ মাসে উত্তাল খোয়াইয়ের পাড়ঘেঁষা থইথই পানি। প্রয়োজন ছাড়া অনেকটা বিচ্ছিন্ন দুই পারের মানুষ। বেশ কয়েক দিন হলো তুমি আর স্কুলে আসোনি। ছটফটে মনকে বারণ করলে কী হবে, বোঝে না সে। ডিঙি নৌকায় চেপে পৌঁছে গেল তোমার উঠানে। আসমানজুড়ে রংধনু যখন শাড়ি বদলায়, খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে তোমার পরান–মন।
বৃন্দাবন সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসেও আমরা একসঙ্গে। কলেজ ক্যানটিন যখন বন্ধুরা মাতিয়ে রাখত, আমরা তখন অনেকগুলো চোখ ফাঁকি দিতাম। চষে বেড়িয়েছি নাগুড়া, সাতছড়ি ও লাউয়াছড়া উদ্যান। লাউয়াছড়ার মূল আকর্ষণ ছিল রেললাইন ধরে আমরা অনায়াসেই মিশে যেতাম সারি সারি পথে। ক্লান্ত শরীরে ছায়াবীথিতে আমরা আশ্রিত হতাম। আহারে! পাখির কিচিরমিচির আর শুকনো পাতার মড়মড়ে শব্দে আমার ঊরুতে মাথা রেখে তুমি আকাশনীলায় মিশে যেতে। আর আমি সোনালি চুলে বেণি কেটে দিতাম, কপালে ছুঁয়ে দিতাম অদৃশ্য চুম্বন।
একবার খেয়াল করে দেখো, চমৎকার একটি মিল ছিল আমাদের। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একসঙ্গেই আছি। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ পাওয়ায় আমরা চেঁচিয়ে উল্লাস করেছি। একটি স্বপ্নকে পাড়ি দিয়ে আমরা তৈরি হয়ে গেলাম। ঢাকার অলিগলি পরিচিত না হলেও পরিচিত হয়ে গেলাম। আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা, জাদুঘর, ধানমন্ডি ৩২, বুড়িগঙ্গার দূষিত বাতাস—কোনো কিছুই অদেখা রইল না।
১ ফাল্গুন আর ভ্যালেন্টাইন ডের সঙ্গে পরিচিত হলেও উৎসব দেখা হয়নি। তুমি বাসন্তী জমিন, লাল পাড় আর গাঢ লীল রঙের আঁচলের শাড়ি পরে রিকশায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ফাল্গুনী দমকা বাতাসে শাড়ির আঁচল আকাশনীলায় মিশে যাচ্ছে। আমার পাঞ্জাবিটাও শাড়ির সঙ্গে বেশ মানিয়ে ছিল। আহা! কী আনন্দ মনের কিনারায়। বেশ কয়েকজন ফটোসাংবাদিকের ক্যামেরায় আমরা ছিলাম অনেকটা আকর্ষণীয়। জীবনের প্রথম বেশ কিছু খবরের কাগজে ক্যাপশনও হয়ে গেলাম, এ যেন অন্য রকম অনুভূতি।
তিলোত্তমা ঢাকা নগরীর রং–ঢঙে হঠাৎ তুমি বদলে গেলে। গ্রামের সোঁধাময়ী মাটির গন্ধ আর বাঙালিয়ানার বৃত্ত ভেঙে দিলে। আমি একটুও অবাক হয়নি পাজেরো গাড়িতে তোমাকে দেখে, এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম। ধনাঢ্য পরিবারের ছেলে জাহিদ ইশতিয়াক এখন তোমার ভালো বন্ধু। তুমি এখন হোটেল র‌্যাডিসন ব্লু, গুলশান ক্লাবের মতো জায়গায় নিয়মিত যাতায়াত কর। টিএসসির সবুজ ঘাসে বসে এখন আর ঝালমুড়ি তোমার মুখে রোচে না। শহীদ মিনারে বসে ফুচকা খেতে খেতে কবিতা ও গান শোনা যেন বোরিং টাইম পাস। বহু স্মৃতি আজও মনে পড়ে, যা মিশে আছে হৃদয়ে। সবকিছুই শূন্য হয়ে গেল, আমার শূন্য মনে। দূরদূরান্তরের ধূলিকণার মতো আমিও আজ বাতাসে ভাসি। বলতে কখনো সুযোগ হয়ে ওঠেনি কিংবা পাইনি, আমিও তোমাকে ভালোবাসি, জাহিদের চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসি।

ইতি
রুদ্র শাহরিয়ার

রামকৃষ্ণ মিশন রোড, হবিগঞ্জ।