'বাড়িত থাকতে ফাঁপর লাগছে রে বাপু'

রোজ সকালে বের হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন বাবা। বেসরকারি সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগের প্রতিষ্ঠানে হিসাব-নিকাশের কাজ করেন বাবা। এই কাজ করেই মানুষ করেছেন তিন মেয়েকে। আবার বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আমি এবার অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ি। বাবার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে আজ পাঁচ বছর হলো।

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বের হন। এক ঘণ্টা হেঁটে এসে গোসল দিয়ে নাশতা করে অফিসে চলে যান। মা দুপুরের খাবার বেঁধে দেন। তারপর ফেরেন সেই সন্ধ্যার পর। কোনো কোনো দিন রাত আটটা বেজে যায়। কারণ, সন্ধ্যাবেলা এক ঘণ্টা হেঁটে তারপর বাসায় ঢোকেন। নইলে শুধু ওষুধ খেয়ে সুগার লেভেল ঠিক রাখা যায় না। এরপর হাত–মুখ ধুয়ে মায়ের সঙ্গে সংসারের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি গল্প–পরামর্শ করেন। তারপর এশার নামাজ পড়ে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েন।
আমার বাবা খুব শান্ত–ধীরস্থির স্বভাবের মানুষ। সহজে রেগে যান না। বেশির ভাগ সময়ই একচিলতে হাসি লেগে থাকে তাঁর মুখে। আমরা তিন বোন খুব জ্বালিয়েছি বাবাকে। আমরা বাবাভক্ত মেয়ে। আমাদের সব আদর–আবদার বাবার কাছে। তিনিও সাধ্যমতো সব পূরণ করার চেষ্টা করতেন। আমার বড় দুই বোনের পাশাপাশি উপজেলাতেই বিয়ে হয়েছে। তাই প্রতি মাসে একবার করে তারাই আসে, মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে যায়।
আর আমরা তিন বোন একসঙ্গে হলে বাড়িতে ঈদ লেগে যায়। হইচই, রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া, গল্প, আড্ডা। বাবা একা থাকতে পারেন না। আমার মা তাঁর এই সংসার নিয়েই সুখী। মা–বাবাকে কখনো ঝগড়া করতে দেখিনি। বরং মা আমাদের শাসন করলে আমরা গাল ফুলিয়ে কান্না করতাম আর বাবা এসে আমাদের মান ভাঙিয়ে কান্না থামাতেন।
আজ কয়েক দিন হলো মা–বাবার মুখে হাসি নেই। সারা দিন কিছু না কিছু নিয়ে কথা–কাটাকাটি চলছে, আবার দুজনেই চিন্তার বলিরেখা নিয়ে সংসারের কাজ করে যাচ্ছেন।
এ মাসে বোনেরাও আসতে পারবে না। প্রতিদিন বড় আপু আর মেজ আপুর সঙ্গে মোবাইলে ভিডিও কলে কথা বলেন। মেয়েদের মুখ না দেখলে শান্তি পান না। যদিও মোবাইলে দেখে তাঁর শান্তি হয় না । দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে?
আজ কয়েক দিন ধরে দেখছি বাবা একটু পরপর টিভি অন করে খবর দেখেন আর বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে জোরে শ্বাস নেন। বাবার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করি, শরীর খারাপ লাগছে কি না। বাবা ফ্যাকাশে মুখে একচিলতে হাসি নিয়ে উত্তর দেন। ‘সারা দিন বাড়িত বসে থাকতে ফাঁপর লাগছে রে বাপু। দিনদুনিয়ার কী হলো? কেমন করে কী হবে কও দিনি। বাইরে হাঁটাচলা না করবা পারলে শরীলও জি ভালো লাগে না। কেমন করে বাঁচমো।’
করোনাভাইরাসের জন্য আজ ১০ দিন হলো বাবা বাড়িতে। বয়স্ক আর অসুস্থ ব্যক্তিরা ঝুঁকির মধ্যে বেশি জন্য আমাদের জেদে বাবা অফিস থেকে আগেই ছুটি নিয়ে বাসায় আছেন। কিন্তু বাবার সকাল-সন্ধ্যা হাঁটা, বন্ধুদের কলিগদের সঙ্গে দেখা হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু ঘর আর বারান্দা করেই আজ বাবার সময় কাটে।
ব্যালকনিতে বসে বাবার সুগারটা মাপলাম। সুগার পয়েন্ট বেড়েছে। বাবা–মেয়ে দুজনেই তাকালাম আকাশের দিকে। অসীম শূন্য আকাশেও কি এক গভীর নিস্তব্ধতা!