মৃত আয়না

মৃত আয়না।
মৃত আয়না।


তুহিন আজ স্কুল থেকে বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। বহুদূরে বসে থাকা শালিক পাখির ডাকে চমকে উঠল। দ্রুত তাকাল। পাখিটি হঠাৎ উড়ে চলে যেতেই তুহিনের মনটা খারাপ হতে লাগল। সে নিজেকে একজন ভারসম্যহীন ব্যক্তি হিসেবে মনে করতে শুরু করছে। ছাদে তার ভালো লাগছে না। সে তার ঘরে চলে গেল। আয়নায় তার এলোমেলো মুখটা দেখল। সে টেবিলে রাখা জগ থেকে খানিকটা পানি খেল। হঠাৎ সে আবিষ্কার করল, সে কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছে। বুকটা খাঁ খাঁ করতে লাগল। সেটা দ্রুত তার মনে এল, সে হঠাৎ থমকে তার বড় আপুর ঘরে চলে গেল। ঘরটা এলোমেলো। বইগুলো বিছানায়, মনে হয় বহুদিন ধরে অব্যবহৃত পড়ে আছে এ ঘরটিতে। তুহিনের মনে পড়ল, এই ঘরটি আপুর সাথে কত না মজা করেছিল। রাতে পড়া না পারলে আপুকে জ্বালাতেও দেরি করত না। কিন্তু আজ এ ঘরটি ফাঁকা লাগছে। পাখিছাড়া খাঁচা যেমন শূন্য থাকে, তেমন এই ঘরটি। শত কান্না করলে কেউ তাকে আদরে গল্প বলবে না। কারণ তার আপু আজ থেকে সাত দিন আগে মৃত্যু নামক দেশে তার আপন বসতি খুঁজে নিয়েছে। লোপা তুহিনের আপু। কলেজে পড়ে, মিষ্টি মেয়ে। এসএসসিতে জেলায় তৃতীয় হয়েছিল। সেদিন বাড়িতে একটা ছোটখাটো পিকনিকও হলো।

রহীমা বেগম তাদের মা। লোপাকে রান্নাও শিখিয়েছিল। লোপা ইলিশ মাছ আর খিচুড়ি রাঁধতে পারত। তার মতো মিষ্টি হতো রান্নাটা। সব সময় ইলিশ পাওয়া যেত না, তখন তুহিন বলত, আপি আজ শুধু কি খিচুড়ি। লোপা, নারে বাঁদর, সঙ্গে ডিমভাজা।
বৃষ্টির দিনে ভাইবোন মিলে ছাদে ভিজত, আবার জ্বরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকত। লোপা তুহিনকে মাঝেমধ্যে মারত, আবার তার কপালে স্নেহের চিহ্ন একে দিত।
লোপা নিয়মিত কলেজে যেত। সে পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকত কিন্তু সে কি জানত তার চিন্তায় অনেক ছেলে ব্যস্ত থাকত। সে যখন কলেজ যেত, এলাকার বখাটে ছেলেগুলো তাকে নানা অকথা-কুকথা বলত। সে জানে, এ সমাজে কিছু বলে কিছু হবে না, তাই না বলে চলে যেত।
লোপার ইচ্ছা, সে পাইলট হবে, বিমানে বিমানে নানা দেশে যাওয়া। একদিন রাস্তার ছেলেগুলো তাকে একটা পোড়াবাড়িতে নিয়ে গেল। তার চিৎকার কেউ শুনল না। এক নারী যান মা নয় সে যেন বাজার থেকে কিনে আনা সস্তা, নগণ্য পণ্য। তাকে নির্মম নির্যাতন করল বখাটেগুলো। তার রক্তাক্ত শিথিল দেহটা ছুড়ে ফেলে দিল ডাস্টবিনে।
নারীর মূল্য কি এই? সেকি ডাস্টবিনের যোগ্য? একি স্বাধীনতার উপহার?
কিছু লোক তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তার তাকে সুস্থ করল। সে বাসায় এল। অনেক সময় পরিচিত স্থান ও অপর পরিচয়ে ব্যক্তিকে পরিহাস করে। সে পড়াশোনা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকত। সে কথা বলত না। এমনকি ভাইয়ের সঙ্গেও না।
লোপা একদিন সুইসাইড করে। অপবাদ–অপমান সে সহ্য করতে পারেনি। সে তো কোনো খোলামেলা পোশাক পরত না। তবে কেন এমন নির্যাতনের শিকার হলো। একজন নারী কি মা নয়, সে কি ভোগ্যবস্তু?
তুহিন ঘটনাটা মনে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। তাকে তো আর আপু মারবে না, কপালে আদুরে চিহ্ন আঁকবে না, খিচুড়ি রান্না করবে না। তার আপু আর তার সঙ্গে বৃষ্টিতে একসঙ্গে ভিজবে না।
কিন্তু এ কি, ওই তো তার আপু। জানালার পাশের বাগানটায় দাঁড়িয়ে। সাদা সেলোয়ারে তাকে ভালো লাগছে। সে আপু বলে ডাকল। আপি আপি।
লোপা ফিরে তাকাল পাথরে চোখ মেলে। যেন কি দেখে ভয় পেয়েছে সে। কিন্তু সন্ধ্যার আলোর মতো তার আপু ও রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।