ত্রিশ বছর পর আয়নার সামনে

ত্রিশ বছর পর আয়নার সামনে।
ত্রিশ বছর পর আয়নার সামনে।


ত্রিশ বছর পর আজ আয়নার সামনে দাঁড়াল সিদ্ধার্থ।
প্রতিদিনকার মতো দখিনা বাতাস,
পুলকিত করল না তার হৃদয়।
যেন বিশাল পাহাড় ঢাল হয়ে বলছে,‘থামো, নভস্বান’
যার মনে জমে আছে পর্বতসম পাথর,
শীতল সমীরণ কি পারবে তার
প্রতিটি হৃৎস্পন্দনকে প্রশান্তির পরশে ভরিয়ে দিতে!
সিদ্ধার্থ নির্বাক, অপলক দৃষ্টিতে দেখছে নিজেকে।

স্মৃতির অন্ধকার, অপ্রাপ্তির বেদনা
আত্মসাৎ করেছে তার সুখ, তার ত্রিশ বছর।
দর্পণ অভিমুখে মনে পরে যায়
‘চবি’র সেই সোনালি দিনগুলো।
ঝাঁকড়া চুল, কাঁধে গিটার,
যার স্লোগানে কাঁপত গোটা রাজপথ;
জারুলতলায় যার কবিতা আবৃত্তি শুনে,
বাউন্ডুলে রমণীরা একদিন কারও
ঘরনি হওয়ার স্বপ্ন দেখত।
যার গানে মাতত কলাঝুপড়ির আড্ডা;

সেই সিদ্ধার্থের স্বতঃস্ফূর্ত আত্মাকে—
যেন পিষে মেরেছে দয়াহীন, গদ্যময় সমাজ।
পালিত্য কেশ, খালিত্য মস্তকে জীবনের আয়নায় দেখে
ত্রিশ বছর আগের সেই সিদ্ধার্থকে।
তার নিজ হাতে আঁকা ছবিগুলোও আজ যেন
বিবর্ণ হয়ে তাকে ধিক্কার দিচ্ছে।

আজ তার বিশাল বাংলোয় সে একা, সঙ্গী নির্জনতা।
অথচ ত্রিশ বছর আগে রেলগেটের স্যাঁতসেঁতে কটেজে
বসে সে স্বপ্ন দেখত—
সুলেখাকে নিয়ে সুন্দর একটি ঘর বাঁধার।

চোখের সামনে থালাভর্তি খাবার থাকলেও
বার্ধক্যজনিত ব্যাধি গ্রাস করেছে তার জঠরাগ্নি।
তার মনে পরে, টিউশনির টাকা জমিয়ে
সপ্তাহে একবার ক্যাফেটেরিয়ায় বিরিয়ানি খাওয়ার কথা।

চাকরি না পাওয়া বেকার সিদ্ধার্থকে ফেলে
সুলেখা যেদিন বিয়ে করল এক প্রবাসী শিল্পপতিকে;
তখন অমাবস্যার রাতে ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়া শাটলের
হেডলাইটের মতো তার রঙিন স্বপ্নগুলোও চলে গেছে
বহুদূর, বহুদূর!
সুলেখার বিয়ের আগের রাতেও
হতাশার মোড়ে দাঁড়িয়ে সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজেছে।
যদি হিমেল হাওয়ায় ভেসে আসে
সুলেখার বিয়ে না হওয়ার খবর।
যদি কোনো দেবদূত এসে শুনিয়ে যেত
তার চাকরি পাওয়ার খবর...

চাকরির সুবাদে আজ বাংলোবাড়ি, পাজেরো কার,
সুসজ্জিত অফিস কক্ষ—সবই তার আছে।
সমাজের কাছে সে আজ সফলতার প্রতীক।
তাঁর জীবনের সফলতার গল্প শুনে
আজও বহু তরুণ সোনালি দিনের স্বপ্ন দেখে!

হঠাৎ সেই মিষ্টভাষী অফিসারের মুখে দেখা দিল
সেই ত্রিশ বছর আগের সিদ্ধার্থের মুখ।
সিদ্ধার্থ চিৎকার করে উঠল, ‘হায় রে টাকা, হায় রে ভাত।’
এবার তার মুষ্টিবদ্ধ হাত এসে আঘাত করে
চূর্ণবিচূর্ণ করল সেই আয়না।
ভগ্ন দর্পণে দেখা যাচ্ছে সিদ্ধার্থের মুখ,
সফলতার প্রতিবিম্ব।
হাতের লাল রক্ত ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে
আয়নার এক একটি কোনায়।
যে রক্তে মিশে আছে সিদ্ধার্থের ত্রিশ বছরের
বুকফাটা আর্তনাদ।